বিশেষ প্রতিবেদক: প্রচলিত আছে, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর রাখার দরকার কী? কিন্তু এবার জাহাজের খবর নিয়েই তোলপাড় ভারতীয় উপমহাদেশ। জাহাজটি এসেছে পাকিস্তানের করাচি থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। এই জাহাজ নিয়েই যত জল্পনা!
গত ৫ আগস্ট পালাবদল ঘটেছে বাংলাদেশে। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর ঢাকা ছেড়ে পালান মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তারপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বজায় থেকেছে। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঢাকায় সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে (১৯৭৪ সালে)। ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে ভুট্টোকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন মুজিব।
জনগণের একাংশ এর প্রতিবাদ করলে মুজিবের পুলিশ তাদেরকে লাঠিপেটা করেছিল। যাইহোক পাকিস্তানের সঙ্গে মুজিবুর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও তার কন্যা হাসিনার আমলে তা ক্রমশ শীতল হয়েছে। পাকিস্তান বিরোধিতাই আওয়ামি লিগ রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু ইউনূস সরকার শেখ মুজিবকে অনুসরণ করেই বোধহয় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিউইয়র্ক ও আজারবাইজানের বাকুতে ইতিমধ্যে শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ইউনূস। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ‘নতুন পাতা’ খোলা উচিত বলে জানিয়েছেন পাক-প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ।
দুই দেশ যে কাছাকাছি আসছে তার আর এক প্রমাণ একটি কার্গো জাহাজ। পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি পণ্যবাহী একটি জাহাজ বাংলাদেশে পৌঁছেছে। মঙ্গলবার জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম করাচি থেকে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এলো। নানা কারণেই পাকিস্তানি জাহাজটি বাংলাদেশে আসার বিষয়টিকে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে।
ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, করাচি থেকে সারাসরি পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে, যা দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ। একে এই অঞ্চলে বাণিজ্য নেটওয়ার্ক জোরদারে একটি বড় পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার।
শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যক্রম বাড়াতে আগ্রহী বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। পাকিস্তানের সঙ্গে কি ইউনূস নিবিড় সম্পর্ক গড়তে চলেছেন, এমন প্রশ্নও উঠছে। একটি সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম ও মোংলা বাংলাদেশের প্রধান দুই বন্দর।
গত ৫ দশকে এখানে পাকিস্তান জায়গা পায়নি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হত সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর মাধ্যমে। কিন্তু এখন পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে। পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ জিনিস বা অস্ত্র আসতে পারে কি না তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে গোয়েন্দা সূত্রে।
আর সেগুলো যদি ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে গিয়ে পড়ে তা মোটেও মঙ্গলজনক নয়। তবে এসব জল্পনা নস্যাৎ করে বাংলাদেশ জানিয়েছে, পাকিস্তান থেকে জাহাজটিতে করে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ। টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। এ ছাড়া কাচশিল্পের কাঁচামাল ভাঙা কাচ আনা হয়েছে ১০ কনটেইনারে। একটি কনটেইনারে রয়েছে গাড়ির যন্ত্রাংশ। পেঁয়াজ আনা হয়েছে ৪২ একক কনটেইনারে। ১৪ ইউনিট কনটেইনারে আলু আমদানি হয়েছে ২০৩ টন। এ ধরনের বাণিজ্য এখন চলবে।
মোদি সরকার শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের মোংলা, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চিনকে দূরে রেখেছিল। গত বছর মোংলা পোর্টের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে চিনের বিরুদ্ধে একটি কূটনৈতিক জয় পেয়েছিল ভারত। কিন্তু এখন পাকিস্তান চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। এই বিষয়টি অবশ্যই এই অঞ্চলের ভূরাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ মায়ানমারও চট্টগ্রামের খুব কাছে। সেখানে এখন টালমাটাল অবস্থা। তাই একটি জাহাজের খবর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সবাই।