নয়াদিল্লি: ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ছাত্রজনতার বিক্ষোভের মুখে ঢাকা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসেন মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা। সেই থেকে ‘রাষ্ট্রীয় মেহমান’ হিসেবে এখানেই আছেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে ড. ইউনূস সরকার। ভারতে থাকার মেয়াদও ফুরিয়েছে। কিন্তু ‘সুসম্পর্ক’-এর কারণেই নাকি মোদি-শাহের আতিথ্যে বহাল তবিয়তে দিল্লিতে বাস করছেন পলাতক হাসিনা। তার মাথার উপর ঝুলছে গণহত্যা, গুম, দুর্নীতিসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধের খাঁড়া। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করতে চলেছে। কিন্তু হাসিনা কি শঙ্কিত? কোথায় আছেন তিনি? ১০০ দিন কেটে গেল, কেমন আছেন পদ্মাপারের টানা ১৬ বছরের শাসনকর্ত্রী? হাসিনাকে নিয়ে বিবিসি একটি রিপোর্ট করেছে। তা থেকে বেশকিছু তথ্য জানা গেছে।
নয়াদিল্লির কেন্দ্রস্থলকে চক্রাকারে ঘিরে রয়েছে যে ইনার রিং রোড, তার ঠিক ওপরেই রয়েছে একটি চারতলা পেল্লায় বাড়ি। ডাক বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ী ঠিকানা ৫৬ রিং রোড, লাজপত নগর, দিল্লি ১১০০২৪। শহরের দক্ষিণপ্রান্তে পাঞ্জাবি অধ্যুষিত ওই এলাকায় এই বাড়িটার আলাদা করে কোনও বিশেষত্ব চোখে পড়ার কোনও কারণ নেই! কিন্তু আসলে ক’জনই বা জানেন প্রায় অর্ধশতাধী আগে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে শেখ হাসিনা যখন প্রথম ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার ঠিকানা ছিল রিং রোডের ওপরে এই ভবনটাই? আসলে তখন ৫৬ রিং রোড ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের একটি ‘সেফ হাউস’। শেখ মুজিব সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধি যখন হাসিনাকে সপরিবার ভারতে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রথমে তার থাকার ব্যবস্থা করেছিল এই বাড়িটিতেই। পরে একাধিকবার হাতবদল হয়ে ওই ভবনটি এখন শহরের একটি ছিমছাম চারতারা হোটেলে রূপ নিয়েছে। নাম ‘হোটেল ডিপ্লোম্যাট রেসিডেন্সি’।
লাজপত নগরের সেই ভবনে এসে ওঠার ঠিক ৪৯ বছর বাদে বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা যখন আরও একবার ভারতে এসে আশ্রয় নিলেন, তখনও কিন্তু শহরে তার প্রথম ঠিকানায় তিনি থিতু হননি। যে কোনও মুহূর্তে তৃতীয় কোনও দেশের উদ্দেশে তিনি রওনা হয়ে যাবেন, এই ধারণা থেকেই প্রথম দু-চারদিন তাকে (বোন শেখ রেহানাসহ) রাখা হয়েছিল দিল্লির উপকন্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটির টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে। কিন্তু চট করে শেখ হাসিনার তৃতীয় কোনও দেশে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর কেন্দ্র সরকার তাকে হিন্ডন থেকে সরিয়ে আনে দিল্লির এক গোপন ঠিকানায়। পরে তাকে হয়তো দিল্লির কাছাকাছি অন্য কোনও সুরক্ষিত ডেরাতে সরিয়েও নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এ ব্যাপারে মোদি সরকার আজ পর্যন্ত কোনও তথ্যই প্রকাশ করেনি। তবে কেউ কেউ বলছেন, দিল্লির লুটিয়েনস বাংলোতে রয়েছেন তিনি।
কিন্তু ‘লোকেশন’ যা-ই হোক, ভারতে তার পদার্পণের একশো দিনের মাথায় এসে এই প্রশ্নটা ওঠা খুব স্বাভাবিক যে এখন শেখ হাসিনাকে কীভাবে ও কী ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে?
অতি গুরুত্বপূর্ণ অতিথি শেখ হাসিনার জন্য কেন্দ্র এখন ঠিক কোন ধরনের নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ করছে? জানা গেছে, যেটুকু না-হলে নয় শেখ হাসিনাকে সেটুকু নিরাপত্তাই দেওয়া হয়েছে, সাদা পোশাকের রক্ষীরাই তার চারপাশে ঘিরে রয়েছেন (জলপাই-রঙা উর্দির কমান্ডো বা সেনারা নন)। আর গোটা বিষয়টার মধ্যে কোনও আতিশয্যর বালাই রাখা হয়নি! মানে ঢাকঢোল পিটিয়ে বা ঘটা করে তাকে কোনও নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না, বরং পুরো জিনিসটাকে খুব নিচু তারে বেঁধে রাখা হয়েছে। সোজা কথায়, তার বেলায় গোপনীয়তাই হল নিরাপত্তা! এটারও অর্থ খুব সহজ, শেখ হাসিনার অবস্থানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষার ওপর, কারণ তিনি কোথায়, কীভাবে আছেন এটা যত গোপন রাখা সম্ভব হবে, ততই তার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা সহজ হবে।
শেখ হাসিনাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া, কিংবা তার সঙ্গে অন্যদের দেখা করানোর ব্যবস্থা, এটাও যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শেখ হাসিনার মুভমেন্টস বা ভিজিটস পুরোপুরি বন্ধ নয়। হাসিনাকে যাতে কোনওভাবেই প্রকাশ্যে না-আসতে হয়, এই প্রোটোকলে সেই চেষ্টাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ফলে দিল্লির মর্নিং ওয়াকারদের স্বর্গ লোদি গার্ডেনে তিনি এসে মাঝেমাঝে হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছেন কিংবা ইচ্ছে করলে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় কাওয়ালি শুনে আসছেন, এই ধরনের যাবতীয় জল্পনা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মকর্তারা! সেই সঙ্গেই তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, এর অর্থ হলো তার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্বও কিন্তু এখন ভারতেরই কাঁধে। তবে গত একশো দিনের ভেতর তার পুরনো পরিচিত ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কেউ কেউ শেখ হাসিনার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করারও সুযোগ পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মেয়ে শর্মিষ্ঠাও দেখা করেছেন বলে সূত্রের খবর রয়েছে। তাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব রয়েছে।
গত মাসতিনেকে শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কথিত ফোনালাপের বেশ কিছু অডিয়ো ‘ভাইরাল’ হয়েছে , যাতে একপক্ষের কণ্ঠস্বর হুবহু শেখ হাসিনার মতোই শোনাচ্ছে। কেন্দ্র যদিও এই সব ‘ফাঁস’ হওয়া অডিয়ো নিয়ে সরকারিভাবে কোনও মন্তব্য করেনি, তবে একাধিক পদস্থ সূত্র একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছে এগুলো বাস্তবিকই শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর!
দিল্লির নর্থ ব্লকের একজন কর্মকর্তা আবার বলছেন, আমি জানি না এটা এআই দিয়ে বানানো হয়েছে, না কি শেখ হাসিনার নিজেরই গলা। তবে তার তো পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলায় কোনও বিধিনিষেধ নেই, এখন কেউ যদি সেই আলাপ রেকর্ড করে লিক করে দেয়, তাতে আমাদের কী করার আছে? কোনও কোনও পর্যবেক্ষক আবার ধারণা করছেন, শেখ হাসিনা যাতে নিজের দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে তাদের মনোবল ধরে রাখতে পারেন, সে জন্য দিল্লিই এই সব কথাবার্তা হতে দিচ্ছে এবং পরে সুযোগ বুঝে তা ‘লিক’ও করে দিচ্ছে! এর আসল কারণটা যা-ই হোক, বাস্তবতা হলো শেখ হাসিনা ভারতে কোনও গৃহবন্দিও নন বা রাজনৈতিক বন্দিও নন, ফলে দেশে-বিদেশে তার পরিচিতদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন। দিল্লিতে থাকা মেয়ে সাইমা ওয়াজেদ বা ভার্জিনিয়াতে থাকা ছেলে সজীব ওয়াজেদের সঙ্গেও তার প্রায় রোজই যোগাযোগ হচ্ছে। নিউজ চ্যানেল, খবরের কাগজ বা ইন্টারনেটেও তার সম্পূর্ণ অ্যাকসেস আছে।
কিছুদিন আগে ফাঁস হওয়া একটি অডিয়োতে শেখ হাসিনার মতো কণ্ঠস্বরে একজনকে বলতে শোনা গিয়েছিল, আমি (বাংলাদেশের) খুব কাছাকাছিই আছি, যাতে চট করে ঢুকে পড়তে পারি! গত সপ্তাহে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীও হয়তো ভাবছেন, তাদের নেত্রীর দেশে ফেরা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা! তবে মোদি সরকার এখনই অতটা আগ বাড়িয়ে ভাবতে রাজি নয়! সাউথ ব্লকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার কথায়, পিচ এখনও প্রতিকূল, বল উল্টোপাল্টা লাফাচ্ছে। এরকম সময় চালিয়ে খেলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে!