Tue, July 2, 2024

ই-পেপার দেখুন

মোবাইল চোর তকমায় ইরশাদকে পিটিয়ে খুন সরকারি হস্টেলে

Bipasha Chakraborty

Published: 29 June, 2024, 01:30 PM
মোবাইল চোর তকমায় ইরশাদকে পিটিয়ে খুন সরকারি হস্টেলে

 

পুবের কলম প্রতিবেদক: গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি এবং হত্যা। এটা বোধহয় এখন রাজ্যের ‘নয়া ট্রেন্ড’। কখনও ছেলেধরা তো কখনও চুরির গুজব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার শিকার সংখ্যালঘুরা। বারাসত থেকে বনগাঁ, খড়দহ থেকে অশোকনগর---এই ‘ট্রাডিশন’ সমানে চলছে। আর এবারের ঘটনাস্থল খাস কলকাতা। গুজবের জেরে প্রাণ গেল এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ইরশাদ আলমের। তাঁর স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, তিনি খেটে খাওয়া মানুষ। তিনি চাঁদনিতে টিভি মেকানিকের হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা থেকে একটু বেহ্তর। কিন্তু চোখে স্বপ্ন ছিল, তাঁর মেয়ে এবং ছেলেকে পড়াশোনা করাবেন। শুক্রবার ইরশাদ আলমের নির্দয় হত্যার পর সব স্বপ্নের ইতি ঘটল। বাড়ির রোজগেরে মানুষের এই নির্মম মৃত্যুতে এখন পুরো পরিবারের সামনে অনাহারের ছায়া। 
কলকাতার বউবাজারে একটি মিষ্টি দোকানের সামনে ফুটপাথ থেকে তুলে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে খুন করা হল টিভি মেকানিক ইরশাদ আলম (৪৭)-কে। অভিযোগ, কলকাতার বউবাজারে রাজ্য সরকার পরিচালিত ‘উদয়ন হস্টেলের’ বেশ কয়েকজন ছাত্র ইরশাদকে রাস্তা থেকে হস্টেলের দো-তলায় তুলে নিয়ে যায়। তারপর দীর্ঘক্ষণ ধরে তাঁর উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। কিল, ঘুষি, লাথি, রড জাতীয় কিছু দিয়ে পেটানো চলতে থাকে আরামসে দীর্ঘক্ষণ ধরে। বেচারা ইরশাদ আলম কোনও কথা বলার সুযোগ পায়নি।
কেন এই নৃশংস আক্রমণ? জানা গেছে, উদয়ন হস্টেলে কোনও এক ছাত্রবাবুর নাকি মোবাইল চুরি গিয়েছিল। মোবাইলের সন্ধান না পেয়ে তারা পার্শ্ববর্তী থানায় অভিযোগও দায়ের করে। শুক্রবার সকালে ইরশাদ আলম চাঁদনিতে দোকানে কাজে যাওয়ার আগে কোনও প্রয়োজনে বৌবাজারে এসেছিলেন। এই সময় এক দোকানদার হস্টেলের ছাত্রদের খবর দেয়, এই লোকটা (ইরশাদ আলম) এলাকায় ঘুরঘুর করছে। এই চোর কী না কে জানে। আর যায় কোথায়! বেশকিছু ছাত্র হস্টেল থেকে বেরিয়ে ইরশাদ আলমকে পাকড়াও করে উদয় হস্টেলের দো-তলায় নিয়ে যায়। আর সেখানে মোবাইল চোর হিসেবে তাঁকে সমানে নিষ্ঠুরভাবে মারধর শুরু করে। মারমুখী ছাত্রদের জিজ্ঞাসার উত্তরে ইরশাদ শুধু নিজের নামটি বলতে পেরেছিল। নাম শোনার পরই অত্যাচারের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। 
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বৌবাজার থানার পুলিশ। তারা হস্টেলে ঢুকতে চাইলে গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর ঘটনাস্থলে পৌঁছয় মুচিপাড়া থানার পুলিশ। তাদের জন্যও দরজা খোলা হয়নি বলে অভিযোগ। এরপর দো-তলায় প্রবল মারধরের পর প্রায় মুর্মুর্ষু ইরশাদকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনা হয়। সে সময় তাঁকে শুধু উর্দুতে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘মুঝে বহুত মারা’। এরপর পুলিশ মারাত্মকভাবে জখম ইরশাদকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
হত দরিদ্র ইরশাদের ঘরে স্ত্রী-সহ ছোট্ট মেয়ে ও ছেলে রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ৪৫ বছর বয়সী ইরশাদের এক বোন। পুবের কলম-এর প্রতিবেদক যখন মুচিপাড়া থানায় পৌঁছায় তখন দেখা যায়, ইরশাদের শোকার্ত প্রতিবেশীরা সেখানে রয়েছেন। আর তাঁর স্ত্রী সালমা বিবিকে পুলিশ থানার ভিতরে নিয়ে গেছে। থানার বাইরে তখন বেশ কয়েকজন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টি মিডিয়ার সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। হয়তো মুচিপাড়া থানার পুলিশ চাইছিল না এই মুহূর্তে সালমা বিবি (ইরশাদের স্ত্রী) মিডিয়ার মুখোমুখি হোক! তাই থানার আধিকারিকরা রাত ১০টা বাজলেও শোকার্ত সালমাকে থানা থেকে বের হতে দেয়নি। এরপর অবশ্য বেশির ভাগ সাংবাদিকই থানার সামনে থেকে চলে যান।

পুবের কলম থেকে মুচিপাড়া থানা ফোন করা হলে, জানানো হয় বড়বাবু (ওসি) নেই, ছুটিতে আছেন। অফিসার অন ডিউটি জানান, তাঁরা শুধু একা নন, তদন্ত করছে বৌবাজার থানারও। মুচিপাড়া থানার আধিকারিককে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনারা ক’জনকে আটক করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আটক করা হয়েছে। কিন্তু ক’জন তা বলা যাবে না। 
পরিবারের দাবি, ইরশাদ কাজ করে খায়। তিনি হস্টেলের ভিতর ঢুকে মোবাইল চুরির মতো অবৈধ কাজে যুক্ত থাকতে পারেন না। সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলে তাঁদের বাড়ির একমাত্র অভিভাবককে হত্যা এভাবে করা হল। ঘটনায় তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। অপরাধীদের কড়া শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। একইসঙ্গে প্রিয়জনকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। অসহায় স্ত্রী-সহ ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে তা ভেবেও আকুল হচ্ছেন পরিজনরা। 
এদিকে, এই লিঞ্চিংয়ের ‘কালচার’ বাংলায় আগে ছিল না। বিজেপি শাসিত গো-বলয়ের রাজ্যগুলিতে এমনটা দেখা যেত। এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। 
উল্লেখযোগ্য হল, যখন মোদি শাসনে গো-রক্ষকরা একের পর এক মুসলিমকে লিঞ্চিং করে হত্যা করছিল তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পশ্চিম বাংলায় লিঞ্চিং বিরোধী একটি বিল পাশ হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যপাল সম্মতি না দেওয়ায় তা আইনে পরিণত হতে পারেনি। তবে এই ধরনের আইনের যে প্রয়োজন, গত কয়েকদিনের ঘটনা তা প্রমাণ করছে। 
স্থানীয় সূত্রে খবর, ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার সকালে। মোবাইল চোর অপবাদ দিয়ে ইরশাদকে বেধড়ক মারধর করা হয়। হস্টেলের দো-তলায় এই নির্মম ঘটনাটি ঘটে। এক ব্যক্তিকে বেধড়ক পেটাতে দেখেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। এই ঘটনায় ছাত্রাবাসের ভিতর থেকে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। এই ঘটনার সঙ্গে ওই হস্টেল সংলগ্ন একটি মিষ্টির দোকানির ভূমিকাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

অভিযোগ, ওই দোকানের মালিকই নাকি শুক্রবার হস্টেলের কয়েকজন ছাত্রকে সেইসময় ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ইরশাদকে দেখিয়ে বলেন, ওই লোকটি এলাকায় ঘুরঘুর করছেন। বৌবাজারের সরকার পরিচালিত ওই উদয়ন হস্টেলের উল্টোদিকে থাকা মিষ্টির দোকানির কথা শোনার পরই হস্টেলের সামনের ফুটপাথ থেকেই ইরশাদকে বেধড়ক পেটাতে পেটাতে তুলে নিয়ে যায় ছাত্ররা। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ এই ঘটনাটি ঘটে। 
পর পর এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকায় বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত বোধ করছেন। তাঁদের বক্তব্য, এভাবে যদি পর পর সংখ্যালঘুদের নানা অজুহাতে টার্গেট করা হতে থাকে, তাহলে তো সম্প্রীতির রাজ্য পশ্চিম বাংলায় বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মতোই পরিস্থিতি গড়ে উঠবে। তাঁরা আরও দাবি করেছেন, সরকারের উচিত এই ঘটনাগুলির পিছনে কারা রয়েছেন, তা তদন্ত করে বের করা। কারণ, কিছুদিন আগে বারুইপুর জেলে পর পর ৪ জন মুসলিম যুবককে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও তাদের মৃত্যু-রহস্য আরও উদ্ধার হয়নি।

 

(নিহত ইরশাদ আলম (বাঁদিকে)। বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় মেয়ে- ছবি সন্দীপ সাহা)

Leave a comment