বিশেষ প্রতিবেদকঃ ২০২০ সালে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে দাঙ্গা হয়েছিল। সরকারি হিসেবে অনুযায়ী, প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫৩ জন যার অধিকাংশই মুসলিম। বেছে বেছে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাজার জ্বালিয়ে দেয় দাঙ্গাকারীরা। এই দাঙ্গা শুরুর আগে বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর বলেছিল-দেশ কা গাদ্দারোকো, গুলি মারো…। কিন্তু দাঙ্গার মামলায় নাম জড়ানো হয় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা উমর খালিদের। খালিদের বাবা এসকিউআর ইলিয়াস বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। দেশে মূল্যবোধভিত্তিক রাজনৈতিক দল ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়ার তিনি শীর্ষনেতা। তার ছেলেকে গত ৪ বছর ধরে একপ্রকার বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। দিল্লি দাঙ্গা মামলায় সম্প্রতি অন্তর্র্বর্তী জামিন পেয়েছেন বামপন্থী ছাত্রনেতা উমর খালিদ। পারিবারিক অনুষ্ঠানের জন্য খালিদের ৭ দিনের অন্তর্র্বর্তী জামিন মঞ্জুর করেছে দিল্লির এক আদালত। তবে ওই সাতদিনের জামিনের জন্যও উমরকে একাধিক শর্ত মানতে হবে। এক-দু’দিন করে চার বছর পেরিয়েছে। বিনা বিচারে জেলে বন্দি উমর খালিদ। অভিযোগ উঠেছে, মুসলিম বলেই তাকে এমনভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে।
উমরের কলকাতার বন্ধু বনজ্যোৎস্না লাহিড়ী। যে উমরের জীবনসাথী হওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করছে। বনজ্যোৎস্নার কাছে উমর খালিদের এক সপ্তাহের জামিন ‘উচ্ছ্বসিত’ হওয়ার মতো বিষয়। তবে সময়টা খুবই সামান্য। তিনি খালিদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দেখা করেন তিহাড় জেলে। তারপর আক্ষেপ করে বলছিলেন, যখন আপনি খুব তৃষ্ণার্ত হন এবং মাত্র দুই ফোঁটা জল পান-তখন যে অনুভূতি হয়, উমরের জামিনও ঠিক তাই।
২৮ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত জামিনে বাইরে বেরোবেন উমর। এক বোনের বিয়ে রয়েছে। লাহিড়ি জানাচ্ছেন, শেষবার যখন ও এক সপ্তাহের অন্তর্র্র্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছিল, তখন পুরো সপ্তাহটাকে দু’দিনের মতো মনে হয়েছিল।
দিল্লি দাঙ্গার ষড়যন্ত্র মামলায় বিচারের অপেক্ষায় উমর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে রয়েছেন। পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে জি এন সাইবাবা, স্ট্যান স্বামীর কথা। তারা জেলে বন্দি থাকতে থাকতেই মারা গেছেন। তাদেরকে চিনতেন উমর খালিদ। তাই তিনি বোঝেন জীবনের মূল্য। বনজ্যোৎস্না বলছেন, এই ভয়ংকর সিস্টেমের কারণে একটা মানুষের জীবন কীভাবে নষ্ট হয়ে যায় দেখুন। জেলে তার সঙ্গে কথা বলার মানুষ নেই। রাতে ঘুম আসে না। রাত দশটার দিকে কয়েকটি রাতচরা বিড়াল আসে উমর খালিদের সেলে। আধ ঘণ্টা সময় কাটায় তাদের সঙ্গে। যেদিন তারা আসে না, সেদিন উদ্বেগে ঘুম আসে না খালিদের।
উমরের বাবা ইলিয়াস দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানাচ্ছেন, ও যখন বাড়িতে আসবে আমরা চেষ্টা করব ভালো ভালো খাবার খাওয়াতে। ওর পছন্দের খাবারগুলি রাঁধা হবে। আত্মীয়স্বজনরা দেখা করতে আসবে। ওকে ক’টা দিন টেনশন-ফ্রি রাখতে হবে। এর আগেরবার যখন জামিন পেয়েছিল ও তো তিনরাত ঘুমায়নি। খালিদ বলত, আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি সময় নষ্ট করতে চাই না!
চার বছর ধরে বিনা বিচারে জেলে বন্দি উমর খালিদ। পিতা ইলিয়াস জামিনের জন্য পায়ের জুতোর তলা ক্ষয় করেছেন বার বার নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের দ্বারে দ্বারে গিয়ে। কেউই সাড়া দেয়নি। দিল্লির সবাই জানে দাঙ্গার সময় ও এখানে ছিল না। ওর বিরুদ্ধে কোনও চার্জ গঠন হয়নি। ও যদি ১৫ বছর জেলে কাটানোর পর বেকসুর খালাস পায় তখন সেটা কত মর্মান্তিক হবে বলুন তো! এর জন্য কে দায়ী— প্রচণ্ড ক্ষোভ ও যন্ত্রণা নিয়ে প্রশ্ন জেলবন্দি সন্তানের বাবার।
ইউএপিএ আইনে কার্যত বিনা বিচারে বন্দি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের মেধাবী গবেষক উমর খালিদ। তাকে নিয়ে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র ‘কয়েদি নম্বর ৬২৬৭১০’। ছবিতে দেখা যায়, আট বছরে আগে জেএনইউ-এর ছাত্র উমর সরস ভঙ্গিতে পথসভায় বলছেন, আমার নাম উমর খালিদ, কিন্তু আমি জঙ্গি নই। আমি তো নিজের মুসলিমত্ব নিয়ে আলাদা করে ভাবতামই না। কিন্তু মুসলিম পরিচয়টাই আমার গায়ে সেঁটে দেওয়া হল। জেলে ইতিমধ্যে ২০০টির বেশি বই পড়ে ফেলেছেন উমর।
দিল্লি-সহ দেশে এনআরসির বিরুদ্ধে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খালিদের। এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছিল তারই শিকার উমর খালিদ-সহ অনেক মুসলিম তরুণ। দিল্লির শাহিনবাগ-সহ নানা জায়গায় টানা চলতে থাকা এই আন্দোলন মোদি সরকারকে শুধু অস্বস্তিতে ফেলে দেয়নি রীতিমতো শঙ্কিত করেছিল। তাই যেভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে বেপরোয়া ও মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার। রাজধানীর বুকে এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল সংখ্যালঘু মুসলিমরা। আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও মোদি সরকারের ভাবমূর্তিতেও আঘাত লাগতে থাকে। দলের কর্মী ও পুলিশ দিয়ে হামলা করে হুমকি দিয়েও যখন আন্দোলন থামানো যাচ্ছিল না তখন আরএসএস-বিজেপি কর্মীরা মিশ্র এলাকায় গিয়ে উসকানি ও প্ররোচনা সৃষ্টি করে, বিদ্বেষ ও ঘৃণা ভাষণ দিয়ে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করতে থাকে। দিল্লির দাঙ্গা এমন ষড়যন্ত্রেরই পরিণতি।
তারপর দাঙ্গার প্ররোচনার দায় চাপিয়ে একে একে গ্রেফতার করা হয় উমর এবং তার সহযোদ্ধাদের অনেককে। সাধারণ কোনও আইনে নয় একেবারে ভয়ংকর কালা আইন ইউএপিএ’র ধারায় তাদের দেশদ্রোহী বলে বন্দি করা হয়। বিভিন্ন সময়কার বত্তৃ«তার টুকরো টুকরো অংশ হাজির করে প্রমাণ করার চেষ্টা হয় তারা হিংসা, মারদাঙ্গা, রক্তপাতের ষড়যন্ত্রে ছক করেছিল। এমনকী বক্তূতায় ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলাটাকেও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে চালানো হয়। নিম্ন আদালত, দিল্লি হাইকোর্ট এমনকী সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকবার খালিদের জামিনের আবেদন খারিজ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ আনা হলেও নির্দিষ্টভাবে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারেনি পুলিশ। বার বার নানা কৌশলে জামিন আটকে জেলে রাখারই চেষ্টা করে চলেছে পুলিশ।
এবার পারিবারিক বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ৭ দিনের জন্য জেলমুক্তি হতে চলেছে উমরের। জেল থেকে বেরিয়ে উমর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবেন। আত্মীয়দেরকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন। তিনি অপেক্ষায় আছেন।