বিশেষ প্রতিবেদকঃ কর্ণাটকের স্কুল-কলেজে হিজাব পরিহিতাদের স্কুল প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং মুসকানের অদম্য সাহসী প্রতিবাদের কথা ও ভিডিয়ো এখন সারা বিশ্বে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। এই নিয়ে মামলা সুপ্রিম কোর্টেও গড়িয়েছে। অনেকেই কর্ণাটকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই ধরণের বিদ্বেষী আচরণের নিন্দা করেছেন। এমনকী কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসও বলেছে, এই হিজাব লড়াইতে তারা নাকি মুসকানের সঙ্গেই রয়েছে।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, হিজাব নিয়ে এই বিতর্ক এখন চলে এসেছে আমাদের প্রগতিশীল রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও। দক্ষিণ ২৪ পরগণার দুটি স্কুল হিজাব পরা মুসলিম মেয়েদের ক্লাসে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করেছে। এর মধ্যে একটি হল আর্যপাড়া পোস্ট অফিসের মোহনপুরে অবস্থিত আড়িয়াপাড়া উচ্চ মাধ্যমিক হাইস্কুল। এই স্কুল সরকার অনুমোদিত এবং এখানে সহশিক্ষার মাধ্যমে কলা ও বিজ্ঞান পড়ানো হয়। অন্য স্কুল হল, দক্ষিণ ২৪ পরগণার নস্করপুর সুকান্ত শিক্ষা নিকেতন।
সব থেকে দুর্ব্যবহার করেছে আড়িয়াপাড়া উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী কেতু বড়াল মহাশয় ও অন্যান্য শিক্ষকরা হিজাব পরে স্কুলের গেট পার হয়ে ক্লাসে আসায় অষ্টম শ্রেণির একটি মুসলিম ছাত্রীকে বলেন, ‘তুমি হিজাব পরে ক্লাস করতে পারবে না। যদি আমাদের স্কুলের পড়তে হয়, তাহলে বাসের মধ্যে কিংবা স্কুল গেটের অনেক আগেই মাথার ওড়না খুলে ফেলতে হবে। মেয়েটি তার ধর্মীয় বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করে হিজাব ‘খুলতে’ রাজি হয়নি। প্রধান শিক্ষক তখন বলেন, তোমাকে এখনই টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) দিচ্ছি। টিসি নিয়ে চলে যাও। কিশোরীটি প্রতিবাদ করে বলে, আমি কী অপরাধ করেছি, যে টিসি নিয়ে চলে যেতে হবে? স্নেহময় প্রধানশিক্ষক কেতু বড়াল তখন কিশোরীটির সমস্যা সমাধান করে বলেন, তুমি তোমার হিজাবসহ কোনও মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হও। ওই কিশোরীটি তখন বলে, তাকে বাড়িতে ফোন করতে দেওয়া হোক। কিন্তু প্রধান শিক্ষক ও অন্য শিক্ষকরা তাতে রাজি হয়নি। তারা ওই কিশোরীটিকে ক্লাস করতে না দিয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টা টিচার্স রুমে জবরদস্তি বসিয়ে রাখেন।
কোনওভাবে তার বাড়িতে খবর গেলে কিশোরীটির মা ও আরও কয়েকজন স্কুল হাজির হন। তখন মেয়েটিকে মুক্তি দেওয়া হয়। আড়িয়াপাড়া স্কুলের মাননীয় প্রধান শিক্ষক মহাশয় আরও বলেন, এটা স্কুল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত, কারণ হিজাব পরলে বিশৃঙ্খলা হবে। অন্য ধর্মের ছাত্রছাত্রীরা হয়তো গেরুয়া পরে স্কুলে আসতে চাইবে। স্কুলের যে ড্রেস কোড রয়েছে, তা ক্ষুন্ন হবে।
প্রধান শিক্ষককে মুসলিম অভিভাবকরা বলেন, বিগত চার-পাঁচ বছর ধরে হিজাব পরেই বেশ কয়েকজন মেয়ে স্কুলে আসছে। তখন কেউ বাধা দেয়নি। আর মেয়েরা স্কুলের ড্রেস কোড মেনেই পোশাক পরে। শুধু তারা মস্তক আবৃত করে একটি ওড়না ব্যবহার করে মাত্র। এতে ড্রেস কোড ক্ষুন্ন হবে কেন।
প্রধান শিক্ষক তখন জানান, হিজাব নিয়ে কর্ণাটকের উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। তার রায় বের হওয়ার পর হিজাব পরা যাবে কী না, সে সম্পর্কে তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন। অভিভাবকরা বলেন, মামলাটি কর্ণাটকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত। তা পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ ২৪ পরগণায় কেন প্রযোজ্য হবে।
বিষয়টি নিয়ে ওই এলাকায় সংখ্যালঘু অভিভাবক ও ছাত্রীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে, নস্করপুর সুকান্ত শিক্ষানিকেতনে কাউকে ক্লাস থেকে বের করে না দিলেও প্রধান শিক্ষক শ্রী হেমাপদ নন্দ হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের বলেছেন, এই স্কুলে আর হিজাব পরে পড়াশোনা করা যাবে না। ক্লাস করতে হলে হিজাবকে বিদায় দিয়ে স্কুলে আসতে হবে। আড়িয়াপাড়া স্কুলে প্রধানশিক্ষককে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
কিন্তু নস্করপুর সুকান্ত শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক হেমাপদ নন্দ টেলিফোনে পুবের কলমকে বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা স্কুলে কাউকে হিজাব পরে আসলে প্রবেশে বাধা দেননি। তবে হিজাব পরলে স্কুলে ড্রেস কোড, শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, সমতা নষ্ট হয়। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এ’ন হিজাব পরে কোনও ছাত্রী স্কুলে আসলে তাকে কী বাধা দেওয়া হবে? তিনি বলেন, এটা স্কুল ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নেবেন। শিক্ষক ছাত্র পাগড়ি পরে আসলে তিনি কী করবেন, প্রশ্ন করা হলে নন্দবাবু বলেন, আইন থাকলে ঢুকতে পারবে।
তিনি ইঙ্গিত দেন, হিজাবধারী ছাত্রীদের জন্য স্কুলের শৃঙ্খলা নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। ওই এলাকার বিধায়ক মোহন চন্দ্র নস্করের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর কাছে কেউ অভিযোগ করলে তিনি বিষয়টি দেখবেন।
নোদাখালি থানার আইসি পার্থসারথি ঘোষ পুবের কলমকে বলেন, এখনও কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। অভিযোগ দায়ের হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।