পুবের কলম ওয়েবডেস্ক : কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘর ছাড়ার ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল’। আর এই সিনেমা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। অভিযোগ, কাশ্মীরের বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরা হয়নি। এই প্রসঙ্গে ‘বিবিসি হিন্দি’ ওয়েব পোর্টাল একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বেদনার দুটি ছবি আছে। একটি, ৯০-এর দশকে ঘর-জমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল এমন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের। আর দ্বিতীয়টি হল, যাঁরা কখনও জম্মু-কাশ্মীর ছেড়ে না গেলেও বছরের পর বছর ধরে এই উপত্যকায় অনিশ্চয়তার ছায়ায় বসবাস করছেন। বিবিসি হিন্দি এইসব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাঁদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা সরকারের কাছে কী চায়? বিভিন্ন সময় কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসা বিভিন্ন সরকার তাঁদের জন্য কী করেছে? কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংগঠন ‘রিনসিলিয়েশন, রিটার্ন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অব পণ্ডিত’-এর সভাপতি সতীশ মহলদার নিজে ‘দ্য কাশ্মীরি ফাইল’ সিনেমাটি দেখেছেন।
এই প্রসঙ্গে সতীশ বলেন, ছবিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেশত্যাগ দেখানো হয়েছে। তবে অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বাছাই পদ্ধতিতে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। এরপরই কিছুটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সতীশ বলেন, যখন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেশত্যাগ করতে হয়েছিল, তখন তো কেন্দ্রে বিজেপি-সমর্থিত ভি পি সিং সরকার ছিল। আর এখন প্রায় ৮ বছর ধরে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ঠিক কি কারণে, কোন পরিস্থিতিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘর ছাড়তে হয়েছিল আমরা তার তদন্তের অনুরোধ করছি। সতীশ আরও বলেন, আজ জম্মু-কাশ্মীরে ৮০৮টি কাশ্মীরি পণ্ডিতের পরিবার রয়েছে, যাঁরা কখনও কাশ্মীর ছেড়ে পালাননি। তাঁরা কীভাবে জীবনযাপন করছেন, তাঁদের জীবনের গল্প কী? ছবিতে এসব কিছুই দেখানো হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘সেই সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু সহিংসতা দেখানো হয়েছে। অনেক কিছুই আবার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বেছে বেছে কিছু অংশ নিয়ে ছবিটি তৈরি করেছেন চিত্র পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। বিজেপি প্রচার করেছে কাশ্মীরিরা পণ্ডিতদের জন্য বসতি স্থাপন করবে। কিন্তু গত ৮ বছর ধরে কেন্দ্রে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। কংগ্রেসও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু, বিশেষ কিছু করেনি। তবুও কংগ্রেস কিছুটা করার চেষ্টা করেছে। জম্মুতে স্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করেছে। সেখানে বাস্তুচু্যতরা থাকতে পারে। তাদের জন্য আর্থিক প্যাকেজও ঘোষণা করা হয়েছিল। মনমোহন সিং সরকারের আমলে ২০০৮ সালে কাশ্মীরি অভিবাসীদের জন্য এই বিশেষ ‘প্রধানমন্ত্রী প্যাকেজ’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই প্রকল্পে, কাশ্মীর থেকে বাস্তুচু্যত পণ্ডিতদের জন্য চাকরি বন্দোবস্তোও করা হয়েছিল। কাশ্মীরি পন্ডিত সহ বিভিন্ন বিভাগের জন্য এই প্রকল্পের অধীনে ২০০৮- ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬০০০টি চাকরির ঘোষণা করা হয়েছে। কাশ্মীরে তৈরি ট্রানজিট হাউসে থাকতে হয় এই মানুষদের।’
এই স্কিমে চাকরি পাওয়া এক কাশ্মীরি পণ্ডিত আবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এই স্কিমটিকে শুধুমাত্র কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বসতি স্থাপনের স্কিম হিসাবে দেখা উচিত নয়। ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে তাঁকে ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। যদিও এখন তিনি এই প্রকল্পের আওতায় কাশ্মীরে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, কাশ্মীরে আমাদের পৈর্তৃক বাড়িটি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তখন আমরা জম্মুতে থাকতে শুরু করি। সরকার প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে সদস্যকে এনে কাশ্মীরে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। তিনি আরও বলেন, তাঁর পরিবারের সবাই জম্মুতে থাকেন। বাড়িতে তাঁর অসুস্থ বাবা-মা আছেন। কিন্তু তাকে চাকরির জন্য তাঁকে কাশ্মীরে যেতে হচ্ছে। জম্মুতে চাকরির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর এখন দুটি যন্ত্রণা,এক তিনি দেখতে পারছেন না তাঁর বাড়ির সবাই কেমন রয়েছেন। একে তো তিনি পরিবার থেকে দূরে থাকেন, অন্যদিকে কাশ্মীরে স্বাধীনতার অনুভূতি পাচ্ছেন না।
কাশ্মীরি পণ্ডিত সংগ্রাম সমিতির সভাপতি সঞ্জয় টিক্কু, হলেন সেইসব কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একজন যাঁরা এখনও কাশ্মীরে বসবাস করেন। তিনি বলেন, জম্মু-কাশ্মীরে মোট ৮০৮টি পরিবার রয়েছে কাশ্মীর পণ্ডিতদের। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেশত্যাগ নিয়ে তাঁদেরদুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যাঁরা দেশ ছেড়ে গিয়েছেন তাঁরা অভিবাসী। আর যাঁরা দেশ ছেড়ে যাননি তাঁরা অ-অভিবাসী। যাঁরা চলে গিয়েছেন, তাঁরা তো গিয়েছেনই। কিন্তু, যাঁরা থেকে গিয়েছেন তাঁদের কথা কেউ ভাবে না। টিক্কু বলেন, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন মনমোহন সিং বাস্তুচু্যত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ঘোষণা করেছিলেন। তখন কাশ্মীরি পণ্ডিত সংগ্রাম সমিতি অ-বাস্তুচু্যত পণ্ডিতদের জন্যও একটি অংশ দাবি করেছিল। ৫০০ জনের চাকরির দাবি জানানো হয়েছিল। তাঁদের বয়স এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতির উপর নজর রাখা এক সাংবাদিক জানান, ৩৭০ রদ করার পর মোদি সরকার দাবি করেছিল কাশ্মীরি পণ্ডিতরা এবার ঘরে ফিরবেন, কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর এক সাংবাদিক জানান, মেহবুবা মুফতি বিজেপির সঙ্গে জোট করে সরকারে ছিলেন। কিন্তু, তখনও পণ্ডিতদের ফেরানোর ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।