পুবের কলম প্রতিবেদকঃ ১৭৮০ সালে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম বিদ্বজনেরা লক্ষ্য করেছিলেন, মুসলিমরা ক্রমশ শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরিতে পিছিয়ে পড়ছে। তাদের অনুরোধেই এই প্রতিষ্ঠান জন্ম নেয় ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা। এখান থেকে উপমহাদেশে বহু গুণী ছাত্র জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এই আলিয়া মাদ্রাসার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহন করেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিলের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে সংখ্যালঘু চরিত্রের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও এখানে সংখ্যাগুরু ছাত্রছাত্রীরা ও শিক্ষকরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সমানভাবে সুযোগ পান।
এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষমও হয়েছিল। কিন্তু এরপর নিজেদের ‘ছাত্রনেতা’ বলে দাবি করে কয়েকজন ছাত্রবিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি ও গণ্ডগোল শুরু করে। এরফলে উপাচার্য, শিক্ষাবিদ আবু তালিব খানকে চলে যেতে হয়।
একথা সত্য ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবিদাওয়া থাকতেই পারে। তা সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংলাপ, আলোচনা ও আন্দোলন হতেই পারে। কিন্তু ভাঙচুর, অসভ্যতা, মারপিট এগুলি কোনওমতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী হতে পারে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসি-র বৈঠকে যোগ দিতে এসে এমএএমই-র তৎকালীন প্রধান সচিব সুরেশ কুমারকে হেনস্থা হতে হয়েছিল। এরপর ভাঙচুর, হুমকি প্রভৃতি অভিযোগে গিয়াসউদ্দিন-সহ ৭ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কারও করেছিল। রবিবার গিয়াসউদ্দিনকে পুলিশ উপাচার্যকে খুনের চেষ্টায় জামিন অযোগ্য ধারা প্রয়োগ করে গ্রেফতার করেছে।
তবে ১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘিরে যে কাণ্ড ঘটে তার নজির সারা দেশে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্মান যে এরফলে ধুলায় মিশে গেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু মুসলিম নয়, সমগ্র বাংলার গুণীজন ও শিক্ষাবিদ্রা ওই ক’টি ছাত্রের চরম অশালীন আচরণে নিজেদের অপমানিত বোধ করছেন। জি ২৪ ঘণ্টায় তথাকথিত ছাত্রনেতা গিয়াসউদ্দীনও স্বীকারও করেছেন, তিনি উপাচার্য মুহাম্মদ আলিকে খুনের হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে গিয়াস যোগ করেন, তাঁর মাথা গরম হয়েছিল বলে তিনি মুখ ফসকে এই কথা বলে ফেলেন।
এখন দেখা যাক, গিয়াসউদ্দিন ভিসিকে তাঁর চেয়ারে ঘেরাও করে কি সব কথা উচ্চারণ করেছিলেন। এর বেশকিছু অডিয়ো ও ভিডিয়ো ক্লিপও প্রকাশিত হয়েছে।ঘেরাও করে ভিসির উদ্দেশ্যে মারমুখী গিয়াসউদ্দিন গালিগালাজ করতে থাকেন। সঙ্গে ছিল তাঁর অনুচররা। তারা উপাচার্যের উদ্দেশে যেসব অকথ্য গালিগালাজ করেন তার কিয়দংশ উল্লেখ করা হচ্ছে। পবিত্র মাহে রমযানের সম্মানে এবং বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রের মর্যাদা রক্ষায় তার সবটা উল্লেখ করা হচ্ছে না।
‘দুটি গালেই চড়িয়ে দেবো। বাঁদর চড়া করে দেবো। আমার চড় খুব লাগে। যে কটা ছেলে বিক্ষোভ করছে তাদের জিজ্ঞেসা করবি। তাছাড়াও দিতে থাকে নিদারুন অশ্লীল গালি, আলিয়ার বেহাল অবস্থা করার জন্য তুই দায়ী ….. (পুরুষ গোপনাঙ্গের উল্লেখ)। তুই আলিয়াটাকে শেষ করেছিস। আমাদের বহিস্কার করেছিস কেন বল? পিএইচডির পরীক্ষার আগে কিছু প্রশ্ন পরীক্ষার্থীকে দিয়েছিস কেন? এ’বে কান ধর। আবু তালিব খানের ….. (পিছনের কথাটির অশ্লীল রূপ) লেগেছিলাম। তোকে (সরাতে) আর কদিন।’
এই ঘটনা সম্পর্কে উপাচার্য মুহাম্মদ আলি পুবের কলমকে বলেছেন, আমার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। ‘তারা’ যে এভাবে ভাষা ব্যবহার করতে পারে, তা ভাবতে পারিনি। বারবার আমাকে মারার হুমকি উচ্চারণ করা হয়। টেকনোসিটি থানার আইসিকে জানানো হয়েছিল। তবুও তিনি আসেননি। আইসি বলেছিলেন, ঠিক আছে, আমি দেখছি। কিন্তু তাঁর কোনও দেখা পাওয়া যায়নি। গিয়াসের ২৬ থেকে ২৭টি বিষয়ে সাপ্লি রয়েছে। গিয়াস যখনই ক্যাম্পাসে ঢোকে তখনই একটা সমস্যা তৈরি হয়। তাই তাকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে বারণ করা হয়েছিল। বিগত বছরগুলিতে ভালো পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। কিছু ‘ছাত্রনেতা’র দাবিদার ফের অশান্তি তৈরি করছে। এর কিছু ভিডিয়ো ক্লিপ প্রকাশ্যে এসেছে। আমি আর কি বলব!
এদিকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তির পিছনে জিম নওয়াজের নাম উঠে এসেছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বা বর্তমান ছাত্র নন। কিন্তু আলিয়া বিশ্ববিদ্যাল কর্তৃপক্ষ ও ভিসির বিরুদ্ধে তিনি ফেসবুকে ক্যাম্পেন করেন। জিম নওয়াজের দাবি, তিনি ক্ষমতাধর শীর্ষ ব্যক্তিদের প্রতিনিধি। তাঁদের হয়ে তিনি কথা বলছেন।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি নিয়ে জিম নওয়াজের যে ভিডিয়োর যে কথোপকথন প্রকাশিত হয়েছে তা তুলে দেওয়া হচ্ছে। আলিয়ার এক ছাত্রকে তিনি আন্দোলন ও অশান্তি করার জন্য প্ররোচণা দিচ্ছে এভাবেঃ
জিমঃ ‘টেকনোসিটি থানার আইসি অনিন্দ্য দে’কে বলে দেওয়া হয়েছে, আলিয়াতে এজিটেশন হবে, আপনি কোনও নাক গলাবেন না। পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। পুলিশ বলেছে, ক্যাম্পাসের বাইরে যাতে মারামারি না করে। মন্ত্রী গোলাম রব্বানি, সাংসদ নাদিমুল হকের সঙ্গে মিটিং হয়েছে। গিয়াস যদিও বাইরের ছেলে। বলে দিয়েছি, যারা ছাত্র তারাই যাবে। বাইরের ছেলেরা যাবে না। তোমরা আন্দোলন করবে, জানাজানি হয়ে গেলে তো ভিসি পালিয়ে যাবে। ‘অর্থাৎ গোপন রাখবে’। এই বিষয়টা আমাদের পাঁচজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কাল বলে এসেছিলাম পুলিশের সঙ্গে উপর মহলের কথা হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে ‘ওরা’ ফোন করছিল। ওদের (বিক্ষোভকারী ছাত্রদের) বলা হয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ‘রেডি’ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যাবে না। পরে তাদের বলেছি, পুলিশের সঙ্গে ওপর মহলের কথা হয়ে গেছে, তাই এবার ক্যাম্পাসে যেতে পারো। আমি পুলিশকে বলেছিলাম, আন্দোলনকারীরা বাইরে (বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে) মারামারি করবে না। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে হলে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ার (দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের)।’
এর প্রতিক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া জিম নওয়াজ-এর বক্তব্যঃ
‘আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার অডিয়ো যে লিক হয়েছে, সেটা আমার কাছেও আছে। এর সঙ্গে কাল বা পরশুর ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা আট মাস আগের অডিয়ো। এটা ঝাড়াই বাছাই করে ছোট্ট ছোট্ট করে কেটে নেওয়া হয়েছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অথরিটির বিরুদ্ধে যে ‘এনকুয়ারি’ হয়েছিল, তার আগের অডিয়ো। ২০২১-এর ২৯ জুলাইর অডিয়ো টেনে আজকের ঘটনার সঙ্গে মেলানো হচ্ছে। এটা একটা ‘প্রোপাগণ্ডা’। এই ঘটনার সঙ্গে অডিয়ো’র কোনও মিল নেই।’
জিম নওয়াজ পুবের কলমকে জানান, ‘আলিয়ার উপাচার্যকে গালাগালি কখনই কাম্য নয়। ১২ তারিখের পর ভিসি থাকছে না। শেষ মুহূর্তে এসে পিএইচডিতে বেনিয়ম করার অভিযোগ উঠছে, ভিসির বিরুদ্ধে। শীর্ষমহলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, এই অডিয়ো ১০ মাস আগের। গত শুক্রবারের ঘটনার সঙ্গে এই অডিয়ো’র কোনও সম্পর্ক নেই। আমি উপস্থিত ছিলাম না। ওখানে গালাগালি তো করতে বলা হয়নি। আলিয়ার বিষয়ে আইসি অনিন্দ্য দে-এর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আলিয়ার উন্নয়নের টাকা ফেরত যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হচ্ছে না। সেখানকার ছাত্ররা বলেছিল, ছাত্রদের দাবিগুলি মন্ত্রী গোলাম রব্বানি, সাংসদ নাদিমুল হককে জানিয়েছিলাম। বিক্ষোভের আগেরদিন, তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল।
বিক্ষোভ নিয়ে এই পর্যন্ত কথা হয়েছে। গালিগালাজ করবে এই নিয়ে কথা হয়নি। খিস্তি বা যে আচরণ করা হয়েছে তা কাম্য নয়।’জিম নওয়াজের বক্তব্য থেকে এটা জানা যাচ্ছে, ছাত্রদের দিয়ে বিক্ষোভ করানোর পিছনে তাঁর হাত রয়েছে। তিনি বলছেন, শীর্ষনেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এই শীর্ষনেতা কারা? কারা টেকনোসিটি থানার পুলিশকে এই বলে ফোন করেছিল, ‘বিক্ষোভ হলেও যাবেন না’? আর সে জন্যই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থানার আইসিকে জানানো সত্ত্বেও তিনি নিজে আসা তো দূরের কথা, পুলিশও পাঠাননি। যেভাবে উপাচার্যকে মারা ও খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল তাতে তো বড় অঘটন হয়ে যেতে পারত।
উপাচার্য ডাকলে পুলিশের তো অবশ্যই আসা উচিত ছিল। কোন ‘শীর্ষমহল’ থানাকে বারণ করে দিয়েছিল আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে যাই হোক, আপনারা যাবেন না? জিম নওয়াজের শীর্ষমহল কারা, তাদের পরিচয় অবিলম্বে উদঘাটিত হওয়া উচিত। জিম নওয়াজ মাননীয় মন্ত্রীর গোলাম রব্বানির নাম উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু গোলাম রব্বানি কখনই আলিয়ায় অশান্তি চাইতে পারেন না। মাননীয় সাংসদ নাদিমুল হকেন নামও জিম নওয়াজ জানিয়েছেন। নাদিমুল হক সাহেবও একজন স্বজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পদে তিনি নেই। তবুও জিম নওয়াজ তাঁর নাম করে তাঁকেও অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা করছেন যা খুবই নিন্দনীয়।তবে এই পরিস্থিতির ফলে মনে হয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ খানিকটা উপকার হতে পারে। কারণ, কারা ষড়যন্ত্রকারী তা কিন্তু প্রকাশ হয়ে পড়েছে।