পারভেজ হোসেনঃ আব্বাসউদ্দিন আহমেদ উভয় বাংলার সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল এক নাম। তিনি উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া–নজরুলের ইসলামী গান– পল্লীগীতি প্রভৃতি গানে অখণ্ড বাংলা– অসমকে মাতিয়ে তোলেন। এইসব গান রেকর্ড করার ক্ষেত্রেও তিনি এক বড় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সন্তানরা বাংলা সঙ্গীত জগতে দিকপালের ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁর পুত্র মুস্তাফা জামান আব্বাসি– কন্যা ফিরদৌসি রহমানও বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে প্রখ্যাত।
এই আব্বাসউদ্দিন কিন্তু আমাদের পশ্চিমবাংলা মানুষ। আব্বাসউদ্দিনের জন্মভিটা কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ ব্লকের বলরামপুরে। তাঁর জন্মভিটায় আব্বাসউদ্দিনের স্মৃতিরক্ষার জন্য তেমন কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। এবার কোচবিহারের এই কৃতী সন্তানের স্মৃতিরক্ষায় উদ্যোগ নিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। রবিবার রবীন্দ্রনাথ ঘোষের উদ্যোগে তুফানগঞ্জের বলরামপুরে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের জন্মভিটায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই বৈঠকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ছাড়াও এদিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভাওয়াইয়া শিল্পী নজরুল ইসলাম– গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান নীরেন দাস সহ জমির মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের শৈশব কেটেছে তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরেই। সেখানেই ১৯০১ সালে তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। শৈশবের শিক্ষা বলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শেষ করে কোচবিহার কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন।
আব্বাসউদ্দিন আহমেদ ১৯২০’র দশকের প্রথম দিকে পুরোপুরি সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। সেখানে বসেই সঙ্গীত জগতে তাঁর হাতে খড়ি। পরবর্তীতে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’– ‘প্রেম না জানে রসিক কালাচাঁদ’– ‘তোর্সা নদীর উথাল পাতাল’ এমন অনেক গানের সঙ্গে আব্বাসের স্মৃতি জড়িয়ে আছে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত প্রেমীদের মধ্যে। বলা হয়ে থাকে– দেশভাগের সময় আব্বাসউদ্দিনের পরিবার জমিজামা বিক্রি করে বাংলাদেশে চলে যান। সেই থেকে শুধুমাত্র আব্বাসউদ্দিনের ‘ডারিঘর’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না এখানে। এক সময় সেই ডারিঘরটিও জীর্ণ হতে থাকে। তবে তাঁর সৃষ্টি বিখ্যাত সেই ভাওয়াইয়া গানের সুর এখনও ভক্তদের টেনে নিয়ে আসে বলরামপুরে। তাই তাঁর জীর্ণ স্মৃতি– সেই ঘরটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়নি। সেটাই এখন তাঁর স্মৃতি হয়ে রয়েছে। সেই স্মৃতিকে রক্ষা করার পাশাপাশি সেখানে ভাওইয়া চর্চার একটি কেন্দ্র ও আব্বাসউদ্দিন-সংগ্রহশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ভাওয়াইয়া শিল্পী নজরুল ইসলাম বলেন– উত্তরবঙ্গের প্রাণের গান ভাওয়াইয়া আর সেই গানের টানে বাংলাদেশ ও অসম থেকে অনেক ভাওয়াইয়া প্রেমীশিল্পী ও সাধারণ মানুষ আব্বাসউদ্দিনের জন্মভিটা দেখতে আসেন। কিন্তু সেই জীর্ণ ডারিঘর ছাড়া আর কিছুই দেখা হয় তাঁদের। তাই এই উদ্যোগ খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
অনেক আগে থেকেই সেখানে ভাওয়াইয়া ও ইসলামি সঙ্গীতের সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের স্মৃতিরক্ষার জন্য কাজ করার ইচ্ছে থাকলেও জায়গার অভাবে সেখানে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে জমির মালিক জমি বিক্রিতে আগ্রহী হওয়ায় ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের জন্মভিটায় স্মৃতিরক্ষায় আশার আলো দেখা দিয়েছে। সেখানে রবিবার বৈঠকের পর ৫ কাটা জমি বিক্রি করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন মালিকপক্ষ। আগামী দু’মাসের মধ্যে একটি কমিটি তৈরি করে জমি কিনে নিয়ে সেখানে প্রাথমিকভাবে শৌচাগার– পানীয় জলের ব্যবস্থা– বসার জায়গা নির্মাণের পাশাপাশি জীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা আব্বাসউদ্দিনের ডারি ঘরটিকে (বসার ঘর) সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়– আগামী দিনে সেখানে একটি সংগ্রহশালা ও ভাওয়াইয়া চর্চা কেন্দ্র নির্মাণ করে ভাওয়াইয়া সম্রাটের বিভিন্ন স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও রবীন্দ্রনাথ ঘোষ জানিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঘোষ আরও বলেন– ‘আমরা এর আগে বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু জমির মালিক জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের স্মৃতিরক্ষায় সেখানে কোনও রকম কাজ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি জমির মালিক ৫ কাটা জমি বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। তারপরেই এই উদ্যোগ নেওয়া হল।’