ইনামুল হক : পবিত্র রমযান মাসে রোযা রেখে চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি, সহ নানা স্বাদের তেলেভাজা ভাজেন বছর ৭৫-এর আবুর আলি। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত-২ ব্লকের খড়িবাড়ির চৌমুহা গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সেই পাঠশালায় পড়ার সময় থেকে তিনি রোযা রেখে আসছেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আল্লাহর হুকুম পালনে রোযা রেখে যাবেন বলে জানালেন আবুর আলি। খড়িবাড়ির চৌমুহা মোড়ে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে ছোট্ট একটা দোকানে দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে তিনি তেলেভাজা ভেজে চলেছেন। রমযান মাস ছাড়াও সারা বছর এই তেলেভাজা বেচেই অসুস্থ বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার চলে। ছেলে নেই, অভাবের সংসারে অনেক আগেই একমাত্র মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। তবে নিয়তির খেলায় আজ কোনও রকমে দিনযাপন করতে হচ্ছে তাঁর। কী সেই নিয়তির খেলা?
আবুর আলি বলেন, ‘অর্থের অভাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শিখলেও খেলাধুলায় আমার একটা ঝোঁক ছিল। ৬০-এর দশকের দিকে কলকাতায় মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ফুটবল প্র্যাক্টিস করতে যেতাম। সে সময় ফুটবল খেলার সুবাদে সেনাবাহিনীতে চাকরিও পেয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির থেকে বাঁধা পাওয়ায় আর চাকরি করা হয়ে ওঠেনি। তা না হলে আজ হয়তো এভাবে দিনযাপন করতে হত না।’ এইসব কথা বলতে বলতে গলা বুঁজে আসছিল নস্টালজিক আবুর আলির। রুটি-রুজির টানে খড়িবাড়ি থেকে মাছ নিয়ে কলকাতার শোভাবাজারে বিক্রি করতে যেতেন তিনি। বেশ ভালোই চলছিল তাঁর ব্যবসা। কিন্তু রোজগারের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াল রাজনীতি। আবুর আলির কথায়, ‘আমরা আগাগোড়াই কংগ্রেস করতাম। আমাদের খড়িবাড়ির তদানীন্তন দাপুটে নেতা মজিদ মাস্টারের ঘনিষ্ঠ সিপিএম নেতা ওই বাজারে মাছ বিক্রি বন্ধে জোর উদ্যোগী হয়েছিলেন। সে সময়ের শোভাবাজার এলাকার সিপিএম নেতা অমর ভট্টাচার্যকে বলে আমাকে ওই বাজারে মাছ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। শুধু একটাই অপরাধ আমরা কংগ্রেস করতাম।’
স্মৃতি হাতড়ে আবুর আলি বলেন, ‘তখন যুব কংগ্রেসের নেত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্ক সার্কাসের মিটিংয়ে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। তার কয়েকদিন বাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় ওই শোভাবাজার এলাকায় মিছিল করছিলেন। বাজারের দোকানদাররা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলেন। পাছে সিপিএম-এর নেতারা যদি আর বাজারে বসতে না দেয়। একমাত্র আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ওনাকে দেখে এগিয়ে গেলে উনি মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় আমার মাছের দোকানে এসেছিলেন। সেই থেকে যেন ওনার প্রতি মায়া পড়ে যায়। পরে বাজারে রটে যায় চাচাকে (আবুর আলি) আর বাজারে বসতে দেওয়া হবে না। সিপিএম নেতা অমর ভট্টাচার্য ওনার অফিসে আমাকে ডেকে পাঠান। যদিও পরবর্তীতে উনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং কী বুঝেছিলেন জানি না, আমাকে পুনরায় ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
সেই থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি ভালোবাসা, আস্থা থেকেই কংগ্রেস ছেড়ে ১৯৯৮ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়ে সরাসরি শাসনে মজিদ মাস্টারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই শুরু করি। আর এই লড়াইয়ে আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন ডা. রঞ্জিত পাঁজা, সৈরেন সেন, বাবলু ঘোষরা।’ এদিকে, সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় সিপিএম বাড়ি ছাড়া থেকে মারধর সবই করেছে। আর সেই সুযোগে শোভাবাজারের সেই মাছের বাজার অন্যজন দখল করে নেয় বলে এই বৃদ্ধ বয়সে এসে আক্ষেপ আবুর আলির। তাঁর দাবি, এই শাসনের মাটিতে আমরা ঘাসফুল ফুটিয়েছিলাম। খড়িবাড়ির স্কুলমাঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এসে আমরাই সভা করেছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একসঙ্গে মিটিং-মিছিল করেছি। আজ আর সেই দলে নতুনরা এসে সম্মান দেয় না বলে ক্ষোভ আবুর আলির। এমনকী বাংলা আবাস যোজনায় একটি ঘরও তাঁর মেলেনি বলে ক্ষুব্ধ তিনি। নিয়তির এই খেলায় তাঁর আক্ষেপ থাকলেও বৃদ্ধ বয়সে এসেও তিনি রোযা রাখছেন, ইফতার ও সেহরির পাশাপাশি মসজিদে জামাতে তারাবির নামাযও আদায় করেন। এটাই এখন তাঁর কাছে অত্যন্ত আনন্দের বলে তিনি জানান। আর তার ভাজা চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি দিয়ে রোযাদাররা ইফতার করেন এটাইবা কম কী? ভেজা চোখে জবাব আবুর আলির।