আহমদ হাসান ইমরান, সাবেক সাংসদ, সম্পাদক পুবের কলম : হিজাব পরার বিষয়টি ধর্মীয়বোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে মুসলিম মেয়েদের কাপড় দিয়ে বুক ঢাকতে ও মাথা আবৃত করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনও কথা বলার এক্তিয়ার উচ্চ বা নিম্ন কোনও আদালতের নেই। আর তা করলে ভারতের সংবিধান ও মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করা হয়, লঙ্ঘন করা ধর্মীয় স্বাধীনতাকেও। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবে এবং ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার যে স্বাধীনতা রয়েছে তা বহাল করবে।
দ্বিতীয় যে কথাটি আমি বলব তাহল, এক্ষেত্রে কেউ জবরদস্তি মুসলিম কিশোরী ও তরুণীদের হিজাব পরাচ্ছে না। হিজাব মুসলিম মেয়েদের নিজস্ব পছন্দ। তারা নিজ ইচ্ছায় হিজাব পড়ছে এবং হিজাব পরার অধিকার বজায় রাখার জন্য তারা যেকোনও ত্যাগ স্বীকারেও রাজি। অনেক ছাত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, তাদের নিজের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বিশ্বাস অনুযায়ী হিজাব পরতে সরকার বা স্কুল কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে তারা বরং পড়াশোনাও কুরবানি করতে রাজি রয়েছে।
আর একটি কথা উল্লেখযোগ্য, স্কুলে মুসলিম ছাত্রীরা কিন্তু স্কুল ইউনিফর্মের সঙ্গে মাথায় হিজাব পরছে। কাজেই ইউনিফর্ম হল না, এই ধরণের কথা বলা সম্পূর্ণ ভুল। আসলে ব্রিটিশ পিরিয়ড থেকেই মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে স্কুলে যায়। তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সউদি আরব, ফিলিস্তিন, সোমালিয়া প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিম ছাত্রীরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী হিজাব পরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়। তাতে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে বা পড়াশোনার মান কমে গেছে এমন কোনও প্রমাণ কিন্তু নেই। ভারতে শিখরা অন্যান্য ভারতীয় সেনাদের মতো ইউনিফর্ম পরেন না। তাদের ইউনিফর্ম একটু আলাদা। তাতে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে কিংবা শিখ সেনাদের বীরত্ব কমে গেছে এমনটা কিন্তু নয়।
গাজালা ইয়াসমিন, অধ্যাপক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় : একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে বিচার ব্যবস্থায় আমাদের আস্থা থাকা উচিত। তবে বলব, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। আমাদের সমাজ বহু-সংস্কৃতির। মানে আমাদের বিভিন্ন জাতি-ধর্ম রয়েছে। মানুষ তার নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরতে পারে। কিন্তু রায়ের মাধ্যমে পছন্দের পোশাক পরার অধিকার আঘাত পাচ্ছে।
অনেকেই উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে বলেই মনে হয়। বিচারব্যস্থার কাজ, সমাজকে ইতিবাচক দিশা দেখানো ও মানবাধিকার রক্ষা করা। আমার মনে হচ্ছে রায়ের মাধ্যমে মুসলিম মেয়েদর শিক্ষার অধিকার বাধাপ্রাপ্ত হবে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। খৃষ্টানরা ক্রশ পরে, হিন্দুরা টিকা-চন্দন পরে, কেউ পাগড়ি পরে, এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। তাই মনে হয়, কর্নাটক হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে সবার স্বার্থ সুরক্ষিত হচ্ছে না। আমরা আশাকরি, শীর্ষকোর্টে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে। বৈচিত্ররা ও বহুত্ববাদ রক্ষিত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
মাওলানা শফিক কাসেমি, ইমাম,নাখোদা মসজিদ : হিজাব মামলায় কর্ণাটক হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে আমরা তাকে মানছি না। আদালতের উপর অবশ্যই সম্মান রয়েছে– কিন্তু আমরা মুসলিমরা এই রায় মানব না। আদালত বলেছে হিজাব ইসলামের অপরিহার্য অংশ নয়, এটা ভুল,ইসলামকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। হিজাব তুলে দিয়ে ফ্যাসিবাদী কালচারকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ধর্মের নামে কিছু ধর্মগুরু যদি খোলা পোশাকে থাকতে পারেন, তাহলে পর্দার সঙ্গে মেয়েরা স্কুল বা কলেজে যাবে তাতে আপত্তি কেন? ধর্ম পালন এবং নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা, প্রসার করা সাংবিধানিক অধিকার, তাকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে আদালতের উপর আস্থা হারাবে মানুষ। আমার মনে হয় রায়ের মাধ্যমে ধর্ম পালন ও নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
সামিম ফেরদৌস, আইনজীবী, কলকাতা হাইকোর্ট : হিজাব নিয়ে কর্ণাটক হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তা সঠিক নয়। কারণ যে কোনও ব্যক্তি তার পছন্দের ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুযায়ী পোশাক পরতে পারেন। পাবলিক প্লেসেও তা করা যায়, স্কুলও একটি পাবলিক প্লেস। তাই স্কুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরতে বাধা দেওয়া যায় না। এ নিয়ে কেরল হাইকোর্টের রায় রয়েছে। তাই আমার মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট সবদিক বিবেচনা করে রায় দেবে এবং অবশ্যই মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার অধিকার রক্ষিত হবে। ধর্মীয় স্বাধীনতার অংশ হিসেবে পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরা ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিষয়, তাই পাগড়ী কিংবা হিজাব পরতেই পারেন। শীর্ষকোর্টে সঠিক বিচার হবে বলেই আমরা আশাবাদী।