কৌশিক সালুই, বীরভূমঃ অবশেষে ডেউচা পাচামি কয়লা শিল্পাঞ্চল নিয়ে জট কাটতে চলেছে। স্থানীয় আদিবাসীদের একাংশ প্রকল্প নিয়ে যে বিরোধিতা শুরু করে প্রায় দেড় মাস ধরে যে ধরণা কর্মসূচি শুরু করেছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলার পর সেই ধরনা মঞ্চে আন্দোলন উঠে গেল। যদিও অন্য এক অংশ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়।
ডেউচা পাচামি প্রস্তাবিত কয়লা শিল্পাঞ্চল নিয়ে বীরভূম জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা নামে স্থানীয় এক সংগঠন বিগত দেড় মাস ধরে এই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়ে ধর্না কর্মসূচি করছিল। গত ১৩ এপ্রিল সে সংগঠনের পক্ষ থেকে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করা হয়। সেখানে ফলপ্রসূ আলোচনার পর ধরনা আন্দোলন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তারা। গত ১৪ এপ্রিল এলাকায় ফিরে এসে তারা অন্যান্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন বারোমেসিয়ার ধরনা মঞ্চ তুলে নেওয়া হবে। যদিও সেখানে একটি অস্থায়ী কার্যালয়ে গড়ে তুলে প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হবে।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট সংগঠনের গুটিকয়েক নেতৃত্ব তারা পূর্বের মত আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায়। সেই সংখ্যা খুবই কম। যদিও সেই বিরোধী আন্দোলন কতটা জোরালো হবে সেটা সন্দেহ থেকেই যায়।
প্রসঙ্গত, ডেউচা পাচামি প্রস্তাবিত কয়লা শিল্পাঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কয়লা শিল্পাঞ্চল এর মধ্যে হতে চলেছে। যে প্রকল্পে লক্ষ্য মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। আগামী কয়েক দশক কয়লার যোগান যেমন নিশ্চিত হবে অন্যদিকে বিদ্যুতের দামও কম হবে। ইতিমধ্যেই প্রকল্প এলাকার আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রায় ২ হাজার জন মানুষ প্রকল্প করার জন্য তাদের নিজেদের জমি দেওয়ার সম্মতি দিয়েছে। সেই সমস্ত জমিদাতাদের জমির প্যাকেজ ঘোষিত নির্ধারিত মূল্য দেওয়ার কাজ চলছে। এছাড়াও জমিদাতাদের পুলিশের চাকরির নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে বর্তমানে। ইতিমধ্যে যারা জমি দিয়েছে তাদের দাবি যে সমস্ত মানুষজন এই প্রকল্প নিয়ে বিরোধিতা করছে তাদের সিংহভাগ প্রকল্প এলাকার বাইরের। বর্তমানে এই এলাকার মূল রোজগার পাথর শিল্পাঞ্চল থেকে। কয়লা শিল্পের ফলে যদি পাথর শিল্প বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তাদের রুজি রোজগার শেষ হয়ে যাবে।
প্রতিদিন কয়েক হাজার লরি পাথরবোঝাই করতে এলাকায় আসে। মেশিন দিয়ে গাড়িতে পাথর লোড করার পর নির্দিষ্ট জায়গায় কয়েকজন করে শ্রমিক সেই পাথর চাড়াই (বেলচা ও ফাওড়া দিয়ে সমান করে দেওয়া) করে দেয় তাতে একটা ভালো টাকা আসে। সারাদিন পর প্রতিটি গাড়ির টাকা জমা করে যে সমস্ত শ্রমিকরা সরাসরি কাজ করে তাদের পাশাপাশি কিছু স্বঘোষিত নেতারা সেই টাকার ভাগ পান। মাথাপিছু ১০০০ টাকা পর্যন্ত প্রতিদিন রোজগার হয় তাদের।
সেই কাঁচা টাকা যাদের রোজগার হয় তারাই সব থেকে চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্রকল্প সমর্থনকারীদের দাবি ওই সমস্ত মানুষজন কয়লা প্রকল্পের সরাসরি বিরোধিতা করতে শুরু করেছিল। একমাত্র যাদের কয়লা প্রকল্পের ঘরবাড়ি জমি জায়গায় যাবে তারা সরকারের নির্ধারিত প্যাকেজ পাবে তাতে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত। কিন্তু বাকিদের আশঙ্কা পাথর শিল্প বন্ধ হলে তাদের কি হবে। যদিও রাজ্য সরকার আগেই ঘোষণা করেছে পাথর শিল্প কোনভাবেই বন্ধ হবে না। পাথর শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের ও পুনর্বাসন এর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়াও উচ্ছেদ হওয়া পাথর ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন দেওয়ার জায়গা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই বলেছেন জোর করে জমি কোনভাবেই নেওয়া হবে না। প্রথম পর্যায়ের প্রকল্প হবে সরকারি জমিতে।
বীরভূম জমি জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার পক্ষ থেকে গণেশ কিস্কু, সাদি হাঁসদা, জগন্নাথ টুডু,, সনদি হাঁসদারা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে আমাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ এবং সমস্ত স্থানীয় এলাকাবাসী খুশি। আমরা যে সমস্ত সমস্যার সমাধান দাবি করে ধরনা প্রতিবাদ মঞ্চ শুরু করেছিলাম মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সে সবকটা সমস্যার সমাধান করবেন বলে কথা দিয়েছেন। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের কাছ থেকে আমরা আস্বস্ত হয়েছি। বারোমেসিয়া গ্রামে ধরনা মঞ্চ চালু রাখা আর প্রাসঙ্গিক নয়। তাই আমরা ধরনা মঞ্চ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনা ও মতামত আদান-প্রদানের জন্য একটি অস্থায়ী কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত কাজকর্ম হবে। তবে ধরনা মঞ্চ তুলে নেওয়ার মানে কোনও ভাবেই আমাদের অন্যান্য দাবি আমাদের আন্দোলন থেকে সরে আসা নয়। ধরনা মঞ্চ তুলে নেওয়াকে যারা আন্দোলন থেকে সরে আসার বলে প্রচার চালাচ্ছেন তারা জেনে বা না জেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। এটা মহাসভা ভেঙে দেওয়ার চক্রান্ত। আমরা এই চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করছি। এই সমস্ত চক্রান্ত অকেজো করে দিতে আমরা জোট বদ্ধ।