Sun, September 29, 2024

ই-পেপার দেখুন

'হিন্দুত্ব' নয়, এই ভোটে ধাক্কা খেয়েছে 'মোদিত্ব'

ইমামা খাতুন

Published: 26 June, 2024, 04:29 PM
'হিন্দুত্ব' নয়, এই ভোটে ধাক্কা খেয়েছে 'মোদিত্ব'

 

সৈয়দ আলি মাসুদ:  মোদি সরকার এখন অতীত। এনডিএ বর্তমান। বিরোধী ও শরিকদের পাশে নিয়ে সরকার চালানোর কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। ১০ বছর পর ‘আমিত্বহীন’ তাঁর এমন আহ্বানে  অনেকের কানেই অন্যরকম লেগেছে। মোদি দক্ষ-কৌশলী রাজনেতা। সময়ের দাবি মেনে নিজেকে বদলাতে পারেন। সব দায় তাঁর ওপরে চাপিয়ে দায়িত্ব সারলে চলবে না। দেশ চালানোর জন্য যোগ্য ভূমিকা নিতে হবে বিরোধীদের। যদি তাদের মনেও হিন্দু সুপ্রিমেসির ঔদ্ধত্য থাকে, তবে তা ছাড়তে হবে। বিদ্বেষকে রাষ্ট্রবাদ ভাবা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে শাসক দল বদলাবে, দেশ বদলাবে না।  

 

কয়েক দশকে মোদি দেশের অগণিত ‘ভক্ত’ ও বিদ্বেষপ্রেমীদের কাছে সফলভাবে যে বার্তা দিতে পেরেছিলেন তা হল, সবার ওপর মোদি সত্য, তাহার উপরে নাই। হিন্দুত্বকে ভিত্তি করে তিনি আপন নয়া রূপের নির্মাণ করেছিলেন। এবারের লোকসভা ভোটে সেই কাঁচা কাঠামো ভেঙে চুর চুর হয়ে গেছে। তবে যারা মনে করছেন এর ফলে হিন্দুত্বের অবসান হবে, তারা ভুল ভাবছেন। 

কারণ এই হিন্দুত্ব মোদি নির্মিত নয়। মোদির স্ক্রিপ্ট রাইটাররা মোদিচিত যে স্ক্রিপ্ট নির্মাণ করেছেন তা অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে ডেলিভারি করেছেন মোদি। সেখানে নেতার থেকেই বহু সময় বড় হয়ে উঠেছে তাঁর ‘অভিনেতা’ প্রতিভা। এমন অভিনয় গুনের কারণে তিনি হাততালি পেয়েছেন ভক্তদের।

এবার সেই স্ক্রিপ্টে হয়তো পরিবর্তন আসবে। তবে হিন্দুত্ব থেকে যাবে নিজের জায়গায়। প্রকট ‘হিন্দু সুপ্রিমেসি’ কেবল প্রচ্ছন্ন হবে। নয়া শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে যে অসৌজন্য ও অসিহিষ্ণুতা মোদির প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তাতে হয়তো সাময়িক ভাটা পড়বে।

কিন্তু আরসএস যে ভারতের নির্মাণ চায় তাতে কোনও বদল আসবে না। কারণ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বহুদলের ভিতরেও সংঘের বীজ রয়েছে। তারাও অনেকে রাষ্ট্রবাদ মানে মনে করে ‘হিন্দু সুপ্রিমেসি’ এবং কণ্ঠ ছেড়ে ‘ভারত মাতা জয়’ বলে আস্ফালন করা। বিপদ সেখানেই। 
 প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে এই ভোট আমাদের কী দিল। এর উত্তর সহজ। এই নির্বাচন ‘ইলেক্ট্রোরাল ডিক্টেটর’কে জায়গা ছেড়ে দিল না। এই নির্বাচন মুসলিমদের মন থেকে ‘ফিয়ার সাইকোসিস’এর সাময়িক অবসান ঘটাল। দেশের মুসলিমদের অনেকেরই মনে হয়েছে হঠাৎ যেন বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা বহুগুনবেড়ে গিয়েছে। সচেতন ও বিদ্বেষমুখী সংখ্যাগুরুদের কাছেও এই নির্বাচন ছিল চ্যালেঞ্জের।

মুসলিমরা বোবা চোখে পড়শি-প্রতিবেশী আপনজন হিন্দুদের কাছে যে প্রশ্ন রেখেছিল তা হল, ‘সত্যিই কি মুসলিমদের ওপর এমন নির্যাতন ও নিগ্রহ তোমরা উপভোগ করো?’ এই নির্বাচনে দেশের সেই অগণিত সংখ্যাগুরু মানুষ জবাব দিয়েছে ইভিএমে। প্রমাণ করেছেন এমন মাত্রাছাড়া বিদ্বেষের পাশে তাঁরা দাঁড়াতে পারছেন না। 

এই মানুষজনের একটি বিরাট অংশ গ্রামীণ ভারতের বাসিন্দা। শহুরে সাদা কলারের লোকজন এবারও ভক্ত সেজেই ভোট দিয়েছেন। মোদিত্বের নির্মাণ চূর্ণ করেছে দেশের আম-আদমি। কেবল রামের নামে এবং বিদ্বেষের নামে মোদির জয়ের আস্ফালনে বাধা হয়ে ওঠেন তাঁরা। বিদ্বেষ-মাখা হিন্দুত্বের আফিম তাদের মুখের সামনে ধরা হয়েছিল বটে, কিন্তু তাঁরা যে তা গিলছেন না, মোদি বাহিনী সেদিকে খেয়াল রাখেনি। 
দেশকে বহুবার বিপদের হাত রক্ষা করেছে, তথাকথিত অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষজন। গোদি মিডিয়ার স্তুতি রিপোর্ট কিংবা এনআরআই নির্মিত রিপোর্ট তাদের উল্লসিত করতে পারেনি। পড়শি দেশে ‘ঘুষকে মারেঙ্গে’ ডায়লগ দিয়ে খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষগুলোকে প্রভাবিত করা যায়নি সম্পুর্ণভাবে। তবে এই কৌশলে দেশজুড়ে সংখ্যাগুরু তরুণ প্রজন্মকে উত্তেজিত করতে সফল হয় মোদিত্ব। 

 

একে বলা যেতে পারে হিন্দুত্বের ‘রিমিক’। বিকশিত ভারতের এমন নয়া হিন্দুত্বের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠছেন পুরাতন সঙ্ঘীরা। কেউ কেউ খানিক বিরক্তও। তারপরও আবেগ তাদের পিছু ছাড়ছে না। ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হয়েছে, এমন খবর শুনে ইহলোক ত্যাগের বাসনা তাদের। ২০১৪ পর্যন্ত তেমনই ভাবতেন তাঁরা। ওরা মনে করতেন বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলে তরুণ প্রজন্ম চাকরি পাবে।

জিনিসের দাম কমবে। রান্নার গ্যাসের দাম কমবে। পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমবে। কিন্তু এর একটিও হয়নি। জিনিসপত্রের দাম মাত্রা ছাড়া। যার কারণে সংসার চালানো সকলের জন্য দুষ্কর হয়ে উঠছে। কিন্তু পুরনো হিন্দুত্ববাদীরা সে কথা মুখে বলতে পারছেন না। এতদিন তারা সরকারের কাছে এসব চাননি। তারা ধরে নিয়েছিলেন হিন্দুত্বের স্বপ্ন ফেরি করা সরকার বুঝি ‘রামরাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা করবে। ফলে তাদের যেকোনও অভাব অনটনে বিজেপি শুনিয়েছিল ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান। দু’বার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ চালিয়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ।

কিন্তু ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’র মতো সামান্য আবদারটুকুও পূরণে সচেষ্ট হয়নি নিজেদেরই হিন্দুত্ববাদী দল। সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া সাধারণ বর্ষীয়ান আরএসএস কর্মীরা অনেকেই খেয়ে-পরে সৎভাবে বাঁচতে চান। রামমন্দির নির্মাণের ঘটনায় তারা বিজেপির ওপর তুষ্ট। কিন্তু পুরনোদের লাইম লাইটে আসতে না দিয়ে সব কৃতিত্ব যেভাবে মোদি নিজে নিয়েছিলেন, তা পছন্দ হয়নি বহু সাধু এবং আরসএসের প্রবীণদের।
দুর্নীতিগ্রস্ত ভিন দলের নেতাদের বিজেপির সম্পদ করে তোলাও তাদের পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে কথা আগে বললে তো মোদির বিজেপি মন ‘ডিরেলড’ হতো না। তা হলে চুপ করে কেন থাকল আরএসএস। এর জবাবে আরএসএস-এর পুরনোরা কেউ কেউ বলেছেন, মোদির দলের কাছে নিজের অস্তুষ্টির কথা জানানো হয়েছিল।

কিন্তু মোদি জমানায় প্রথম এত বিপুল অর্থের মালিক হয়ে ওঠে বিজেপি। তাঁরই জমানায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করা গুজরাতি শিল্পপতিদের সাহায্যে একটা ভিন্ন রাজনৈতিক ইকোসিস্টেম তৈরি হয়। যা আগে হয়নি। আর্থিক স্বচ্ছতার দাবি তোলা বিজেপি ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে যে কাণ্ড করেছে তাতে অস্বস্তিতে প্রবীণ আরএসএসরা। কিন্তু শাখামুখি নবীনদের এসব নিয়ে হেলদোল নেই। বিদ্বেষের স্টেরয়েড গিলে তারা চনমনে। হিন্দু সুপ্রিমিসি তাদের আন্দোলিত করছে। 

পড়শি দেশে ঢুকে হামলার খবর তাদের অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থির ক্ষরণ বাড়ায়। দুর্ণীতিকে তারা জাস্টিফাই করে। বিদ্বেষকে ধর্ম মনে করে। মুসলিমদের ওপর অত্যাচার তাদের কাছে রাষ্ট্রবাদ। এরা ধর্মগ্রন্থের ভিতরে উদারতার জায়গায় সংকীর্ণতা খোঁজে। এদের সবথেকে ভরসার জায়গা হল হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় ও গেরুয়া আইটি সেল। মোদিত্বে দেশজুড়ে যে নয়া বিদ্বেষপ্রেমীদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে তার দায় আরএসএসের প্রবীণরা অস্বীকার করতে পারেন না। তারা সেদিন যদি দেশপ্রেম ও হিন্দু আধিপত্যবাদকে সমার্থক করে না তুলতেন, তাহলে মোদি নিজের এমন ভাবমূর্তি বানাতে পারতেন না। তাহলে তাদেরও এমন করে অবজ্ঞা করতে পারত না বিজেপি।
বিদ্বেষমুক্ত হয়ে দেশকে যদি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সেক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলোর দায়িত্ব সবথেকে বেশি। মনে রাখতে হবে, তাদের দলেও আরএসএসের লোক রয়েছে। যারা মনে করে এই দেশটা হিন্দুদের। বাকিরা নেহাতই আশ্রিত। তাদের মনে রাখতে হবে এমন মানসিকতাই দিনে মোদিত্বের জন্ম দেয়। ভোটে কে জিতল আর কে হারল বড় কথা নয়।

ভোটে কোন আদর্শ জিতল আর কাদের আদর্শ হারল সেটা বড় কথা। যদি বিদ্বেষ সত্যিই পরাভূত হয়, তাহলে দেশ এগোবে। আর তা না হলে বিলিয়নারদের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে দারিদ্র সীমার নিচে থাকা মানুষদের ভিড়। কেবল সরকার নয়, আজ যারা বিরোধী তাদের প্রত্যেককেই একথা মাথায় রাখহতে হবে। তা না হলে হিন্দুত্বের নয়া নয়া রূপে কোনও না কোনও মোদি ফিরে ফিরে এসে গণতন্ত্রের কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা করবে। তাই সাবধান থাকতে হবে সকলকে।

Leave a comment