Sun, September 29, 2024

ই-পেপার দেখুন

লোকসভা নির্বাচন ২০২৪: নেতাহীন মুসলিমদের ভাবাবেগ মাপার চেষ্টা

Puber Kalom

Puber Kalom

Published: 06 June, 2024, 02:48 PM
লোকসভা নির্বাচন ২০২৪: নেতাহীন মুসলিমদের ভাবাবেগ মাপার চেষ্টা

তারিক আনোয়ার: ২০২৪ সালের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নজিরবিহীন ও উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। অথচ ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ দখল করে রয়েছে মুসলিমরা। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কংগ্রেস ও ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নানা নীতি ও ক্রিয়াকলাপ এই বেহাল দশার অন্যতম কারণ।

 

মুসলিম ভোট পাওয়ার লড়াইয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে কেননা ভারতে তারাই দ্বিতীয় সংখ্যাগুরিষ্ঠ সম্প্রদায়। দেশের ৯০টি জেলায় ৭২০টি বিধানসভা আসন ও ১০০ লোকসভা আসনে এই সম্প্রদায়ের প্রভাব রয়েছে। প্রায় ১০০টি লোকসভা আসনের নির্বাচনী ফলাফল নির্ভর করছে মুসলিমদের ভোটের উপর।

 

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, লাক্ষাদ্বীপের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ শতাংশ মুসলিম। তারপর রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর (৬৮ শতাংশ), অসম (৩৪ শতাংশ), পশ্চিমবঙ্গ (২৮ শতাংশ), কেরল (২৭ শতাংশ), উত্তরপ্রদেশ (১৯ শতাংশ), বিহার (১৭ শতাংশ), ঝাড়খণ্ড (১৫ শতাংশ), উত্তরাখণ্ড (১৪ শতাংশ), দিল্লি ও কর্ণাটক (১৩ শতাংশ করে), মহারাষ্ট্র (১২ শতাংশ), গুজরাত ও অন্ধ্রপ্রদেশ (১০ শতাংশ করে), রাজস্থান (৯ শতাংশ), মধ্যপ্রদেশ (৭ শতাংশ) ও তামিলনাড়ু (৬ শতাংশ)।

 

নির্বাচনের আগে এই সম্প্রদায়কে দলে টানতে সমস্ত রাজনৈতিক দলই তৎপর কারণ সংখ্যাগত দিক দিয়ে তাদের পরিমাণ অনেক কিছু নির্ধারণ করতে পারে। এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপিও সুফি ও পসমন্দা (পিছিয়ে পড়া) শ্রেণির মুসলিমদের কাছে টানতে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদী নীতি ফলে তাদের উদ্যোগ সম্ভবত সফল হবে না। মসজিদ, মন্দির, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে জোর দিয়েছে তারা। কংগ্রেসের মতো দলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু-তোষণের অভিযোগ তুলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। এ সবই তাদের মুসলিমদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

 

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস, মুসলিমরা যখন ভোট দেয় তখন বিজেপি থাকে তাদের শেষ পছন্দের তালিকায় কিংবা একেবারে পছন্দের বাইরে। কিন্তু একই সঙ্গে, তাঁরা স্বীকার করেছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপির প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি সামান্য হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজে (সিএসডিএস) কর্মরত অধ্যাপক হিলাল আহমেদ বলেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৬ শতাংশ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৯ শতাংশ মুসলিম ভোট পেয়েছে। এই পরিসংখ্যান প্রচলিত বিশ্বাসের উল্টো। অনেকের বিশ্বাস, মুসলিমরা বিশেষ করে বিজেপিকে হারাতে ভোট দিয়ে থাকে। ভোট দেওয়ার সময় মুসলিমরা দলের চেয়ে প্রার্থীর দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। নির্দিষ্ট আসনে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের উপর তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করে থাকে।

 

তবে, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক রাশিদ কিদওয়াই এই মতকে সমর্থন করেন না। তাঁর দাবি, বিভাজনমূলক পরিস্থিতিতে মুসলিমরা এ দেশে সবচেয়ে বেশি ভুগছে মুসলিমরাই এবং বিজেপি উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ভাবে রাজনীতিতে বিভাজন নিয়ে আসছে।তিনি বলেন, ততাই, মুসলিমরা কংগ্রেস বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির  মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলকে সমর্থন করতে আগ্রহী।

 

কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (আইএনডিআইএ) নিশ্চিত যে, মুসলিমদের ভোট শেষ পর্যন্ত তারাই ঝোলায় পুরবে কারণ এই সম্প্রদায়কে ব্যাপক ভাবে দমন-পীড়নের অভিযোগ রয়েছে বিজেপির বিরুদ্ধে এবং মুসলিমদের কাছে অন্য কোনও বিকল্প নেই। এই কারণেই হয়ত এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব এত কম বা প্রাক-নির্বাচনী বিজ্ঞাপন ও প্রতিশ্রুতিতে তারা অনুপস্থিত।

 

কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে হাতে গোনা মুসলিমের জায়গা হয়েছে। মুসলিম ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে এই দুই দল অনেকের চেয়ে এগিয়ে। উত্তর ভারতে মুসলিম অধ্যুষিত আসনেও যাদব প্রার্থী দেওয়া হবে। উত্তরপ্রদেশের আসন সংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি ইলেক্টোরেট মুসলিমদের হাতে, তবে এই ধরনের আসনে ইন্ডিয়া জোটের সামাজিক শ্রেণির হাতে ১০ শতাংশেরও কম ভোট থাকলেও তারা সেখানে হিন্দু প্রার্থী দাঁড় করাবে।

 

রাজনৈতিক ফায়দার জন্য মুসলিম-তোষণের অভিযোগ তোলা হয় যে দলের বিরুদ্ধে প্রায়শই, সেই কংগ্রেসও তাদের এক বিজ্ঞাপন থেকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের (ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী) ছবি সরিয়ে দিয়েছে এবং সেই বিজ্ঞাপন সারা দেশে একাধিক প্রথম সারির সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত বিজ্ঞাপনে দলের কর্মকর্তাদের ছবির মধ্যে ছিল ভি পি সিং-এর ছবি। সাবেক এই কংগ্রেসী দলত্যাগ করেছিলেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আপাত ভাবে, মূল লক্ষ্য ছিল, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব অমুসলিম দেখানো যায় নিজেদের তা করা।

 

লখনৌতে থাকা সাংবাদিক আসাদ রিজভি প্রশ্ন তোলেন, তকংগ্রেস কেন মুসলিমদের নিয়ে চিন্তিত হবে? যে-দল মনে করে এই জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে কংগ্রেস ছাড়া এই সম্প্রদায়ের কোনও বিকল্প পথ নেই। তিনি বলেন, কংগ্রেস আসলে হিন্দু ভোটারদের চটাতে চাইছে না কারণ তাদের বিশ্বাস, হিন্দু ভোটই তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। তারা হয়ত ইচ্ছাকৃত ভাবে এই সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছে যে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় বিজেপিকে দৃঢ় ভাবে আঁকড় ধরে রয়েছে।

 

তাঁর মতে, মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝানোর জন্য বিজেপি একদল তপ্রভাবশালী মুসলিমদ ও তস্বতন্ত্র মধ্যস্থতাকারীকেদ নিযুক্ত করেছে। এদের মাধ্যমে বিজেপি মুসলিমদের বোঝাতে চাইছে, তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপর আস্থা রাখতে পারে, যিনি তপ্রকৃতই তাদের ভালদ চান এবং বিজেপি তাদের জন্য একটা তনির্ভরযোগ্য বিকল্পদ। তিনি বলেন, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক তারিক মনসুরকে বিজেপি ও আরএসএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত মৌলবাদীরা লাগাতার নিশানা করেছে। তিনি বিজেপি সমর্থকদের এই দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 

উত্তরপ্রদেশের বিধান পরিষদের সদস্য ও গেরুয়া দলের জাতীয় সহ-সভাপতি এই শিক্ষাবিদ সরাসরি মুসলিমদের সঙ্গে আলাপ করেন না। মাঝে মাঝে বিজেপি সরকারের নানা উদ্যোগের প্রশংসা করে নিবন্ধ লেখেন। বিজেপির অস্পৃশ্যতাদকে মুসলিমরা যাতে এড়িয়ে যায় তা বোঝানোর জন্য তিনি মোদি প্রশাসনের নানা পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করবেন। কিন্তু কেউ যদি তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেন, তাহলে তিনি এ নিয়ে কোনও কথা বলবেন না। তিনি নিজেকে মুসলিম ও আরএসএসের মধ্যে তসেতুদ বলে অভিহিত করেন। মুসলিমদের ধর্মীয় উপাসনাস্থল ধ্বংস, তাদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া, এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রতি লাগাতার হুমকি, মুসলিম মেয়েদের জন্য মৌলানা আজফ এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া ও গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা নিয়ে মোদি সরকারের দ্বিধা-দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি পাশ কাটিয়ে যেতে চান ও ফোন কেটে দেন।

 

মুসলিম সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের নীতিকে উপেক্ষা করতে চায় ইন্ডিয়া জোটও। এমনকি, এই জোটের মুসলিম সাংসদরাও দলের নীতি বিষয়ে নিজেদের মতামত দিতে অনিচ্ছুক।

Leave a comment