Sat, June 29, 2024

ই-পেপার দেখুন

পানির ভাগ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে অন্ধকারে রেখে কোনও চুক্তি সম্ভব নয়: মুখ্যমন্ত্রী মমতা

Bipasha Chakraborty

Published: 26 June, 2024, 01:25 PM
পানির ভাগ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে অন্ধকারে রেখে কোনও চুক্তি সম্ভব নয়: মুখ্যমন্ত্রী মমতা

 

আহমদ আবদুল্লাহ:  নদীমাতৃক বাংলাদেশ। কথাটি যখন বলা হয়, তখন অবশ্য যে ভূ-খণ্ডটির কথা মাথায় রাখা হয়, তা হল বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলা। এই দু’টি ভূ-খণ্ড মিলেই বিভাগপূর্ব কালের বাংলাদেশ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে বলেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। পরে বাংলাদেশ এই গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করলেও পশ্চিম বাংলার বাঙালিরাও কিন্তু এই গানটি সমাদরের সঙ্গেই গেয়ে থাকেন। ভূ-খণ্ড সেই ‘সোনার বাংলা’। 
তাই দু’দেশ হয়ে যাওয়ার পর নদীমাতৃক এই ভূ-খণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে পানি ভাগের এবং নদীকেন্দ্রিক পলি, মাছ চাষ, ভাঙন ইত্যাদি নিয়ে বেশকিছু মতভেদ তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে এখন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সামনে এসেছে তিস্তা ও গঙ্গার উপর ফরাক্কা বাঁধের চুক্তি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করে দুই দেশের মধ্যে প্রবহমান তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন--- এ কথা সংবাদমাধ্যমে আসার পরই সমস্যা তৈরি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব কড়া ভাষায় চিঠি লিখে হিন্দুস্তানের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানিয়ে দিয়েছেন, ঢাকাকে তিস্তা নদীর পানির ভাগ দেওয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়। ফলে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশে যে আশাবাদের জন্ম হয়েছিল, তা অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অবশ্য তিস্তার পানি বণ্টনের দাবি জানিয়ে ২০১১ সাল থেকে অপেক্ষা করে চলেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমোদন না পাওয়ায় নয়াদিল্লি ইচ্ছা সত্ত্বেও ঢাকার সঙ্গে কোনও চুক্তিতে যেতে পারেনি। 
মোদিজি যে শেখ হাসিনার সম্প্রতি ভারত সফরে তাঁকে খানিকটা খুশি করার জন্য তিস্তার পানি বণ্টন এবং ফরাক্কায় গঙ্গার পানি চুক্তি নবীকরণের জন্য যে সবুজ সংকেত দিয়েছেন, তার পিছনে আর একটি কারণও রয়েছে। খালেদা জিয়াকে হারিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসার পরই ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, এবার থেকে আর বাংলাদেশকে কোনও মতেই ভারতের প্রভাব বলয়ের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। কারণ, ভারতের ‘পিছনের উঠোন’ বা পৃষ্ঠ-ভূমিতে থাকা বাংলাদেশকে সামলে রাখতে হবে নয়াদিল্লিকেই।

প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরির এই পরামর্শকে যে সরকারই আসুক, নয়াদিল্লি কখনোই ভুলে যায়নি। বাংলাদেশেও আওয়ামি লিগ সরকারও ভারতের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি করে গেছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্ব ভারতে সড়ক ও রেল পথে মালামাল প্রেরণ, নৌ-পথের ব্যবহার, ব¨রের ব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তবে ভারতের সবথেকে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘাঁটি থেকে ভারত বিরোধী জঙ্গিদের সম্পূর্ণ উৎখাত। 
শেখ হাসিনাও ভারতের নানা সাহায্যের কথা কখনোই বিস্মৃত হননি। এমনকী যখন বাংলাদেশের শেষ নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন’ করার জন্য শেখ হাসিনার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল, তখন ভারত ‘বন্ধু’ আওয়ামি লিগের পাশে দাঁড়িয়ে মার্কিন ও পাশ্চাত্যের চাপকে অবহেলা করতে পুরোপুরি সহযোগিতা করেছে। 
তবে আর একটি বিষয় রয়েছে, চিন শুধু লাদাখ বা অরুণাচলেই নয়, বাংলাদেশেও নয়াদিল্লির ঘরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই গত ১০ বছরে বেজিং ঢাকার সঙ্গে সখ্যতার এক নজির গড়ে তুলেছে। শুধু বাণিজ্য নয়, চিন পরিকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশকে নানা ধরনে সাহায্য প্রদান ও সহায়তার ওয়াদা করে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। স্বাভাবিকভাবেই নয়াদিল্লির তা মোটেই পছন্দ নয়। 
সেই চিন ওয়াদা করেছে, তারা বাংলাদেশে প্রবহমান তিস্তার অববাহিকায় ভূমি সংরক্ষণ এবং পানি ব্যবস্থাপনা করার জন্য শুধু কারিগরি নয়, বরং সহজ শর্তে প্রাথমিকভাবে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবকে এখনও প্রত্যাখ্যান করেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার সঙ্গে ১০টি চুক্তি করা ছাড়াও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শীঘ্রই ভারত বাংলাদেশে তিস্তার পানি বণ্টন, জলবিদ্যুৎ প্রভৃতি বিষয়ে খতিয়ে দেখতে এক বিশেষজ্ঞ দল প্রেরণ করবে। 
নদীর পানিপ্রবাহ ভারতে রাজ্যের তালিকাতেও পড়ে। কাজেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠিন প্রতিরোধের মুখে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে চুক্তি কার্যকর করা সম্ভব নয়। মমতা ব¨্যােপাধ্যায়ের বক্তব্য, তিস্তার পানির প্রবাহ কমে এসেছে।  পশ্চিম বাংলার উত্তরবঙ্গ তিস্তার পানির প্রবাহের উপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। সেজন্য কোনও মতেই উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশকে পানি দেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও যে আপত্তি তুলেছেন তা হচ্ছে, ফরাক্কায় গঙ্গার ব্যারেজের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ এবং পানির ভাগ নিয়ে। ফরাক্কা ব্যারেজ ও গঙ্গার পানির হিস্যাদারি নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি হয়েছিল, তা ২০২৬ সালে শেষ হতে চলেছে।

মোদিজি শেখ হাসিনাকে ওই চুক্তিটি ফের নবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে খবর। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আপত্তি তুলেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে এই চুক্তির নবায়ন চলবে না। গঙ্গার ভাঙন প্রতিরোধ ও অন্যান্য বিষয়ে কেন্দ্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং এ জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল, তা এখনও পশ্চিমবঙ্গ পায়নি। কাজেই পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা ও তিস্তা চুক্তির ‘গঙ্গা প্রাপ্তি’ না হলেও বিষয়টি এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনমনীয় প্রতিরোধের মুখে লৌহ প্রাচীর তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও তা উপলব্ধি করেছেন। তিনি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খানিকটা নাক গলিয়েই বলেছেন, মমতা মোদিজিকে চিঠি লিখে যা বলেছেন তা আমি সমর্থন করি। 

Leave a comment