Sun, September 22, 2024

ই-পেপার দেখুন

'নৈতিকতাই স্বাধীনতার ভিত্তি' কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে জামাআতে ইসলামী হিন্দের প্রোগ্রাম

Bipasha Chakraborty

Published: 22 September, 2024, 12:23 AM
'নৈতিকতাই স্বাধীনতার ভিত্তি'  কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে জামাআতে ইসলামী হিন্দের প্রোগ্রাম

পুবের কলম প্রতিবেদক:  শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে জামাআতে ইসলামী হিন্দের উদ্যোগে এক কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসব্যাপী দেশজুড়ে ক্যাম্পেইন বা প্রচারাভিযান চালাচ্ছে জামাআত। যার শিরোনাম হল 'নৈতিকতাই স্বাধীনতার ভিত্তি।' সেই উপলক্ষেই এদিনের প্রোগ্রাম শুরু হয় দারসে কুরআনের মাধ্যমে। সূরা আল আহযাব এর ৩৫ নং আয়াতের তরজমা ও তাফসীর করেন জামাআতে ইসলামী হিন্দের বিভাগীয় রাজ্য সম্পাদক মাওলানা এএফএম খালিদ। 



ইনস্টিটিউট হল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সংগঠনের বিভিন্ন জেলা থেকে নারী ও পুরুষ মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক সদস্য, কর্মী অংশ নেন। স্বাগত ভাষণ দেন জামাআতের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মশিউর রহমান। 


দৈনিক পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক তথা রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমেদ হাসান ইমরান এই কনভেনশনে বলেন, সমাজে প্রচলিত সবরকম খারাবী দূর করতে হবে। কিন্তু কে করবে? আইন তৈরি করে তো সবকিছু করা সম্ভবপর নয়। সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব নিতে হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজনকে। এ জন্যই মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব করে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আমাদের দায়িত্ব হল ন্যায়ের প্রতিপালন এবং অন্যায়-জুলুমকে প্রতিরোধ করা। ইসলামের গাইডলাইন মেনে চললে অভিশাপ-মুক্ত হবে সমাজ। পৃথিবী আমাদের বাসযোগ্য থাকবে। তাই আজ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়াজ উঠছে, 'ব্যাক টু দ্য বেসিক।' দেড় হাজার বছর আগে কুরআন বলেছে, 'ফা ফিররু ইলাল্লাহ', অর্থাৎ ফিরে এসো আপন প্রভুর দিকে। স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় কী হচ্ছে? কোথায় রাষ্ট্রসংঘ, কোথায় মানবাধিকার? গাজাবাসীর কি কোনো স্বাধীনতা নেই, তাদের কি মানবাধিকার নেই?

ইমরান সাহেব আরও বলেন, আমেরিকা-ইউরোপ যদি অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা বন্ধ করে দেয় তাহলে হামাস জয়ী হবে এবং ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হবে। গাজাবাসীর পাশে আন্তর্জাতিক মহল নেই, কিন্তু তারা একমাত্র আল্লাহর ভরসায় এই যুদ্ধে ১১ মাস ধরে ইসরাইলকে প্রতিরোধ করছে। তিনি এও বলেন, শুধু গেল গেল রব তুললে হবে না, নেতিবাচক চর্চা বা আক্ষেপ করলে হবে না, তরুণ প্রজন্মের সামনে বিকল্প সংস্কৃতি, বিকল্প প্ল্যাটফর্ম উপহার দিতে হবে। তাওহীদের ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না। এমন একটা গভীর সামাজিক সংকট উত্তরণের পথ অন্বেষণে এই কর্মসূচি নেওয়ায় জামাআতে ইসলামীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।


রামকৃষ্ণ মিশন ও অ্যানসেস্ট্রাল হাউস অফ স্বামী বিবেকানন্দ অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার এর সেক্রেটারি স্বামী জ্ঞানলোকানন্দজী মহারাজ বলেন, ঈর্ষা, ঘৃণা, ক্রোধের কাছে আমরা পরাজিত ও পরাধীন হয়েছি। এ থেকে মুক্তির চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, পিতার চাইতে গর্ভধারীনি মাতা শ্রেষ্ঠ। ইসলাম ধর্মে মায়ের পায়ের নীচে জান্নাত বলা হয়েছে। নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পিতার তুলনায় তিনগুণ বেশি মর্যাদা দিয়েছেন মাতাকে। মায়ের সমতুল্য শিক্ষক আর কেউ নেই। তাই নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান না থাকলে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আজ সবথেকে বেশি ক্ষতি করছে শিক্ষিত মানুষরা। নীতি-নৈতিকতা বর্জিত এই শিক্ষায় প্রীতি-সম্প্রীতি কোথায়? এত অসহিষ্ণুতা কেন? কেন এত ঘৃণা-বিদ্বেষ? তাঁর মতে ধৈর্য্য ও ক্ষমাই হল মূল কথা। দয়া, মায়া, স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, প্রীতি হল আমাদের আত্মার আত্মীয়। 


জামাআতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি মাওলানা আব্দুর রফিক বলেন, প্রত্যেককেই স্বাধীন করে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আমরা সেই স্রষ্টা প্রদত্ত স্বাধীনতা পাইনি। যা পেয়েছি, সেই স্বাধীনতার মানদণ্ড কী? আর কেমনটা হওয়া উচিত – এই দ্বন্দ্ব নিরসন করতে হবে। স্বাধীনতা যথার্থভাবে পেতে হলে মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। অবাধ স্বাধীনতার কারণে স্বাধীনতা তার স্বরূপ হারাচ্ছে। তাঁর কথায়, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আধারে গঠিত হবে সমাজ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে পিটিয়ে হত্যা কিংবা জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা থাকলে স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় থাকতে পারে না। অন্যের বিপদে-দুঃখে, প্রতিবেশীর সমস্যায় একজন মুসলমান ঝাঁপিয়ে পড়বে, সমব্যথী হবে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে – এটাই ইসলামের নৈতিক শিক্ষা। অন্যায় দেখে চুপ থাকলে আখেরাতে সেই ব্যক্তিকে অন্ধ করে তোলা হবে। তাই সাবধান। মুসলমানকে ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধ গর্জে ওঠা, প্রতিবাদে শামিল হওয়া আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। এই শর্ত পূরণ না হলে সে মনুষ্য পদবাচ্য নয়, আল্লাহর দরবারে মুসলমান হিসেবেও গণ্য হবে না। 


আমীরে হালকা ডা. মসিহুর রহমান বলেন, নৈতিকতা এবং স্বাধীনতা দুটো বিষয়কে আলাদা করে দেখলে হবে না। সব দেশেই সভ্য সমাজে স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানেও স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রীর কথা আছে। স্বাধীনতা না থাকলে তাকে আনসিভিলাইজড বলা হয়। সেটা সভ্যতার পরিপন্থী। তাই স্বাধীনতাকে কোনভাবেই হরণ করা যাবে না। তাহলে সামাজিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। স্বৈরাচার, ফ্যাসিজম, সামরিকতন্ত্র থাকলে স্বাধীনতা ভূলুন্ঠিত হয়। স্বাধীনতাকে বলাৎকার করা হয়। 


তিনি আরও বলেন, ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকে বিপ্লবের পর থেকে স্বাধীনতার ধারণা গড়ে ওঠে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব এর পর স্বাধীনতার দাবি উচ্চারিত হয়। কিন্তু এটা সঠিক নয়। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন বিশ্ব-সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক আন্দোলন ও সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ বিপ্লবের কাজ শুরু করেন, সেই থেকেই স্বাধীনতার শুরুয়াত। তাই বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল ব্যক্তি হলেন নবী (সা.)। পুঁজিবাদ, ভোগবাদ, বস্তুবাদ, পরকীয়া, সমকামিতা, অবাধ যৌনতা – এসব কি মানবতার জন্য কল্যাণকর? এর বৌদ্ধিক চর্চা হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন ডা. মসিহুর রহমান। নৈতিকতা বিবর্জিত স্বাধীনতার কারণে যা ইচ্ছে, তাই হচ্ছে। সেখানে কোনো লাগাম বা নিয়ন্ত্রণ নেই। তারই পরিণামে সামাজিক সংকট, নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের বিপর্যয় ত্বরান্বিত হচ্ছে। 


তিনি এও জানান, পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে আমেরিকায় ৬৯ শতাংশ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে। ভারতে খুব শীঘ্রই এটা ৫০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। কারণ, হিসেবে তিনি বলেন, স্বাধীনতার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। নৈতিকতার ধারণাকে সর্বত্র বলবৎ করতে হবে। নৈতিক আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। এর মাধ্যম হল ঐশী পথনির্দেশিকা। এবং আল্লাহর হেদায়াত, তাওহীদ বা একত্ববাদ মানুষের সামনে স্পষ্ট করতে আহ্বান জানান তিনি। এও বলেন, বিশ্বনবী (সা.) এর প্রদর্শিত পথ ও পন্থাকে অনুসরণ ও অনুশীলন করলে সমাজে অনাবিল সুখ-শান্তি আসবে। সবশেষে তিনি বলেন, ইসলাম হল একমাত্র বিকল্প, ইসলামই হল একমাত্র প্রতিষেধক।


জামাআতের রাজ্য সম্পাদিকা মঞ্জুরা খাতুন বলেন, ডিজিটাল যুগে আজ নৈতিকতার বড়ই অভাব। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সংকট প্রকট। অধিকার নিয়ে আমরা চিন্তা করি, কিন্তু দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা ভুলে যাই। নৈতিকতা হল মূল্য এবং বোধের সমষ্টি। হযরত আলী (রা.) বলেছিলেন, সম্পদকে পাহারা দেয় মানুষ; কিন্তু মানুষকে পাহারা দেয় জ্ঞান। এই জ্ঞান হতে হবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নির্যাস। তবেই একজন মানুষ মানব-সম্পদ হয়ে উঠবে। আর নারীজাতিই হল মানব সম্পদ তৈরির খনি বা উৎস। অথচ নারীকে আজ স্বাধীনতা, অধিকার ও ক্ষমতায়নের নাম করে কত নীচে নামিয়ে আনা হয়েছে। নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করা হয়েছে। অথচ নারী কখনও ভোগের নয়; বরং নারী হল ত্যাগের প্রতীক। তাই ইসলাম বলছে, নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হল পর্দা বা শালীন পোশাকবিধি। 


প্রাক্তন আমীরে হালকা মুহা. নূরুদ্দিন শাহ বলেন, মানুষকে যথাযথ স্থানে পৌঁছে দেয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। পাশ্চাত্যের ভোগবাদী চিন্তাধারা সমাজকে কলুষিত করছে। মানুষের সঙ্গে পাশবিক ও দানবিক আচরণ করা হচ্ছে। ফলে হাসপাতাল থেকে স্কুল এমনকি মন্দিরেও ধর্ষণ এবং ধর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে। ধর্ষণের প্রতিবাদী মিছিলে পর্যন্ত ধর্ষণ হচ্ছে। তার মানে আগুন নেভাতে পানি নয়, পেট্রোল ঢালা হচ্ছে। মোবাইলে, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির রমরমা। বিছানায় শুয়ে তরুণ প্রজন্ম অনলাইনে সাট্টা, জুয়া, লটারি খেলছে। সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণ করছে মদ, ড্রাগ ইত্যাদি। আবগারি দফতরের তাই এত কদর। সরকার মদ ব্যবসা ও দেহ ব্যবসায় ঢালাও লাইসেন্স দিচ্ছে। সমকামিতা, বহুগামিতা, বিবাহ বহির্ভূত অবাধ যৌনতা, লিভ টুগেদার, লিভ ইন রিলেশন ইত্যাদি ছাড়পত্র পেয়েছে। অর্থাৎ সমাজ ধ্বংসের যাবতীয় উপকরণ সহজলভ্য করে দেওয়া হয়েছে। এসবের একমাত্র অ্যান্টিভাইরাস হল কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা। মানবতার রক্ষাকবচ হল নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সংবলিত ঐশী পথনির্দেশনা। এটাই আদর্শ জীবনদর্শন হওয়া উচিত। যা ইচ্ছা তাই করা নয়, এ জীবন হল পরীক্ষাগার। সকল কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এই চেতনাই মানুষকে পরিশুদ্ধ এবং সমাজকে সংশোধন করতে পারে। কেউ শ্রেষ্ঠ আর কেউ নিকৃষ্ট নয়। সবার শরীরে একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এই শাশ্বত শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন বিশ্বনবী (সা.)।


এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জামাআতে ইসলামীর রাজ্য সেক্রেটারি মাওলানা তাহেরুল হক, আব্দুর রহিম, সেখ সুজাউদ্দীন, এফডিসিএ-র সেক্রেটারি আব্দুল আজীজ, এসআইও-র রাজ্য সভাপতি সাঈদ মামুন ও সেক্রেটারি ওয়াকিল আহমেদ, সলিডারিটি ইয়ুথ মুভমেন্ট এর রাজ্য সভাপতি ওসমান গনি, জামাআতের মিডিয়া সেক্রেটারি মুস্তাফিজুর রহমান-সহ দক্ষিণবঙ্গের সব জেলার নাযিম ও নাযিমাগণ।

Leave a comment