Sat, September 21, 2024

ই-পেপার দেখুন

‘শহীদি রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানী,   ফিলিস্তিনি সংগ্রাম ও একজন ইসমাইল হানিয়া

Bipasha Chakraborty

Published: 01 August, 2024, 02:26 PM
‘শহীদি রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানী,   ফিলিস্তিনি সংগ্রাম ও একজন ইসমাইল হানিয়া
সমর্থকদের সঙ্গে ইসমাইল হানিয়া

 

আহমদ হাসান: চলছে মুহাররম মাস। মুহাররম মাস হচ্ছে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কুরবানির। এর মধ্যে আমরা লক্ষ করছি, ফিলিস্তিনের গাজায় এবং পশ্চিম তীরে আক্ষরিক অর্থে হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু যায়নবাদী নৃশংসতার শিকার হয়ে শহিদ হয়েছে এবং হচ্ছে।

হচ্ছে কথিত ‘সভ্য বিশ্ব’-এর গণতান্ত্রিক দুনিয়ার এবং ‘মানবাধিকার প্রেমী’ রাষ্ট্রগুলির চোখের সামনে। বলতে গেলে আল জাজিরা চ্যানেলের ২৪* ৭ সম্প্রচারে সকলের ঘরের টিভির পর্দায়। ফিলিস্তিনে আহতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যা নিয়ে কেউই আপত্তি তোলেনি। খোদ রাষ্ট্রসংঘ থেকে শুরু করে যায়নবাদের পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই কিন্তু বলেনি আহত, নিহত বা গৃহহীনদের এই সংখ্যা মনগড়া কিংবা অপপ্রচার। সবাই তা মেনে নিয়েছে। 

আর এরই মধ্যে ঈমানের উপর ভরসা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সরবরাহকৃত অত্যাধুনিক হাতিয়ার, ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান থেকে বর্ষানো ভয়ংকর বোমা প্রভৃতির বিরুদ্ধে ১০ মাস ধরে লড়ে চলেছে হামাসের যোদ্ধারা। হ্যাঁ, তাদের কুরবানি দিতে হচ্ছে। কিন্তু সেজন্য তারা প্রস্তুত। ২৪ ঘণ্টা হল শহিদ হয়েছেন হামাসের সর্বোচ্চ নেতা ইসমাইল হানিয়ে। তিনি শহিদ হয়েছেন সহমর্মী দেশ ইরানের রাজধানী তেহরানে।

ইসমাইল হানিয়া কোনও সামরিক নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন হামাসের রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান। কিন্তু সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল যদি ভেবে থাকে যে এভাবে কাপুরুষের মতো ব্যক্তি-হত্যা করলে তারা ফিলিস্তিন ও মসজিদুল আক্সা কবজা করার যুদ্ধে জিতে যাবে, তা কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল।

হামাসের অসম সাহসী যোদ্ধারা ইসমাইল হানিয়ের শাহদতে তাদের মনোবল কমেনি বরং তা আরও বেড়েছে। তাঁরা বলছেন, ‘হানিয়ের এই নৃশংস হত্যা আমাদের মনোবলকে আরও সুদৃঢ় করেছে।’ হানিয়ের এই কুরবানি সম্পর্কে বলা যায়, 

‘জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনি জানি, শহীদি রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগী।' 

ফিলিস্তিনি নেতা ইসমাইল হানিয়া ছিলেন দক্ষ ও সাহসী সংগঠক। ২০০৬ সালে গণতান্ত্রিক ভোটে ফিলিস্তিনের গাজা অঞ্চলে হামাসের জয়ের পিছনে হানিয়ের অবদান অসামান্য। হানিয়ে ২০০৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ২০০৭ সালে তাঁকে বরখাস্ত করেন।

২০১৭ সালে ইসমাইল হানিয়া হামাসের প্রতিরোধ আন্দোলনের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। ইসরাইলি অবৈধ দখলদারি ও বর্বরতার বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবর, ২০২৩ সালে ইসরাইলে অসম সাহসী অভিযান চালানোর পর ইসমাইল হানিয়ে বলেছিলেন, আমরা অসংখ্যবার আপনাদের হুঁশিয়ার করেছি যে, ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনি জনগণ রিফিউজি ক্যাম্পে জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু আপনারা আমাদের জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন। 

আর একটি বক্তৃতায় ইসমাইল হানিয়া বলেছিলেন, ফিলিস্তিনি জনগণ আজাদি ও মর্যাদার বিনিময়ে তাঁদের সমস্ত কিছু কুরবানি করতে রাজি রয়েছেন। তিনি আরও বলেন যে, যায়নবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিন জনগণের বিরুদ্ধে তাদের ক্রাইম এবং সন্ত্রাসী আক্রমণের জন্য অবশ্যই এক বিরাট মূল্য চুকাবে। তিনি ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের বেসামরিক নারী-পুরুষের উপর যায়নবাদীদের বর্বর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছিলেন। 

সকলেই জানেন, কীভাবে নিজভূমিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের পরবাসী করেছিল এবং সন্ত্রাস ও নৃশংসতার দ্বারা ২,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি বসবাসকারী উৎখাত করেছিল। আর তাদেরই সমর্থনে ১৯৪৮ সালে সৃষ্টি করা হয় যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রকে। আর তারা ফিলিস্তিনি আরবদের উপর লাগাতার অত্যাচারের পাহাড় চাপিয়ে দেয়।

আর হ্যাঁ, তথাকথিত ‘সভ্য দুনিয়া’ ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানির প্রত্যক্ষ মদদে আর্থিক, সামরিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতায় ইসরাইল তার সন্ত্রাসী অস্তিত্ব এখনও বজায় রাখতে পেরেছে। আর এখানেই রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিকতাবাদীদের ৭৫ বছরের লাগাতার অবৈধ দখলদারি ও বর্বরতার ইতিহাস। অনন্যোপায় হয়ে প্রতিরোধের আন্দোলন বেছে নিয়েছে ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণ।

আর গত দুই দশক ধরে এরই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ইসমাইল হানিয়ে ও তাঁর কয়েকজন সহযোগী। যায়নবাদীদের দ্বারা হানিয়ের হত্যা প্রমাণ করে যে, তিনি সঠিকভাবেই ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। 

তবে ইসমাইল হানিয়ের কাপুরুষোচিত হত্যা কিন্তু আরও হাজার হাজার হানিয়ের জন্ম দেবে। তার প্রমাণ হচ্ছে, তাঁরা হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা বৃদ্ধ ও পঙ্গু আহমদ ইয়াসিনকে ফজরের নামায আদায় করে হুইল চেয়ারে বেরিয়ে আসার সময় একইভাবে মিসাইল দিয়ে হত্যা করেছিল। তারপর ফিলিস্তিন জনগণের নেতা ইয়াসির আরাফাতকেও ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।

কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলন আরও শক্ত হয়েছে, আরও মজবুত হয়েছে। কতটা মজবুত হয়েছে, তা বোঝা যায় যখন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও দক্ষ সামরিক শক্তির অধিকারি বলে দাবি করা ইসরাইল ১০ মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সহয়তায় লড়াই করেও হামাসকে পরাজিত করতে পারেনি।

তাতেই বোঝা যায় যে, ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী হামাস কতটা মজবুত। আশা করা যায়, ইসমাইল হানিয়ের অভাব পূরণ করতে সৃষ্টিকর্তা আরও বহু হানিয়ের জন্ম দেবেন। আর এজন্য তৈরি হয়ে রয়েছে ফিলিস্তিনের তরুণ যোদ্ধারা। 
 

Leave a comment