বিশেষ প্রতিবেদকঃ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বাংলার শিক্ষাপ্রেমী এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭৮০ সালে আধুনিক ও ইসলামি শিক্ষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার জন্য প্রথম প্রতিষ্ঠান। তারপর অনেক বাধা– উতরাই– সংগ্রাম পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সংখ্যালঘু চরিত্রসম্পন্ন এই বিশ্ববিদ্যালয়। আর পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা প্রদানে অসামান্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
গুরুত্ব বিবেচনা করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম থেকেই রাখা হয়েছিল জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন। ভাবা হয়েছিল পশ্চিমবাংলা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নতিতে সাংবাদিকতার মাধ্যমে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা এবং মাস কমিউনিকেশনে এখানকার ছাত্রছাত্রীরা উজ্জ্বল ভূমিকা রাখবে। প্রথমে বাড়ি ভাড়া করে টেকনো-ইন্ডিয়াকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সংবাদিকতা কোর্স পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। টেকনো-ইন্ডিয়া সিনিয়র সাংবাদিকদের এনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কোর্স পড়ানোর ব্যবস্থা করে।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান মিডিয়া ও মাস কমিউনিকেশন বিভাগের সঙ্গে তুলনা করলে স্বীকার করতেই হবে– টেকনো-ইন্ডিয়া আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পারফরম্যান্সের থেকে ভালই ফল করেছিল। এ কথা এই জন্য বলা হচ্ছে– আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া ও মাস কমিউনিকেশনের বর্তমান বিভাগীয় প্রধান ড. মুহাম্মদ রিয়াজকে প্রশ্ন করা হয়েছিল– আগের বছরগুলির কথা বাদ দিলেও তিনি ৫ বছর ধরে আলিয়ার সংবাদিকতা বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে রয়েছেন– বর্তমানে বিভাগীয় প্রধান। পশ্চিমবাংলায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আলিয়ার ছাত্রছাত্রীরা কী ধরনের অবদান রেখেছে? খানিকটা ভেবে ড. মুহাম্মদ রিয়াজ মিডিয়ায় কর্মরত আলিয়ার সফল ছাত্রছাত্রী হিসেবে যে ৩-৪ জন ছাত্রছাত্রীর নাম উল্লেখ করলেন– তাঁরা হলেন শাহরিয়ার হোসেন (বর্তমানে মিলেনিয়াম পোস্ট)– সেখ কুতুবউদ্দিন (পুবের কলম)– রিমা সাহা (পুবের কলম)। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে এরা সকলেই টেকনো-ইন্ডিয়ার ছাত্রছাত্রী– ডিগ্রিটা মাত্র দিয়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
তার আগে অবশ্য মুহাম্মদ রিয়াজ ‘পুবের কলম’কে বলেছেন– পশ্চিমবাংলায় মিডিয়া ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি নগণ্য। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল– এই বাংলায় বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি মুসলিম রয়েছে। কিন্তু ইংরেজি ও বাংলা সাংবাদিকতায় মুসলিমদের উপস্থিতি খুবই সামান্য– এটা কেন? তিনি বলেছিলেন– এখনকার তরুণ-তরুণীদের সাংবাদিকতায় আগ্রহ খুব কম। তিনি স্বীকার করেন– কলকাতা ও বাংলায় সাংবাদিকতায় মুসলিম উপস্থিতিকে ‘নমিনাল’ হিসেবে বর্ণনা করা যায়।
‘পুবের কলম’ থেকে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়– আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া বিভাগে এখন তিন-তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রয়েছেন। রয়েছে সুন্দর পরিবেশে অনেকগুলি ঘর– ছোট হলেও রয়েছে লাইব্রেরি– কম্পিউটার এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ শেখানোর জন্য বেশ কিছু সরঞ্জাম। যদিও উপরিউক্ত ক্ষেত্রগুলিতে আরও সমৃদ্ধ হওয়া প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া পার্ক সার্কাসের মতো স্থানে শহরের মধ্যস্থলে এই বিভাগের ক্যাম্পাস অবস্থিত।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ও মাস কমিউনিকেশনের বিভাগীয় প্রধান ড. রিয়াজকে প্রশ্ন করা হয়– আপনি বলছেন আপনারা নাকি বিভাগ প্রতিষ্ঠার এতদিন পরও ছাত্রছাত্রীই পাচ্ছেন না– এটা কেন? জবাবে ড. রিয়াজ বললেন– আমি তো ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সাংবাদিকতা পড়ার আগ্রহ দেখি না। আমরা প্রতি বছর স্নাতকোত্তর বিভাগে কমপক্ষে ৪০ জন ছাত্রছাত্রী নিতে পারি। কিন্তু আসলে ভর্তি হয় মাত্র ২০-২১ জন। আর তাদের মধ্যে শেষপর্যন্ত টিকে থাকে মাত্র ৫-৬ জন।
এই একই বিষয়ে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. কাইফিয়া আনসার লস্কর পুবের কলমকে বললেন– আসলে পশ্চিমবাংলায় ছাত্রছাত্রীদের সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করার খুব একটা আগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় না। এর একটা কারণ হয়তো এখানে সাংবাদিকদের বেতন খুব কম। প্রথমে হয়তো মাত্র ৫-৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অসমে অবশ্য সাংবাদিকদের বেতন শুরু হয় ১৫-২০ হাজার টাকায়। তাই সেখানে সাংবাদিকতায় আগ্রহ বেশি। তিনি আরও বলেন– আলিয়া থেকে প্রতি বছর ৫-৬ জন উত্তীর্ণ হলেও অনেকে কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন। সম্প্রতি দু’জন দূরদর্শনে চুক্তিভিত্তিক চাকরি পেয়েছেন। এ ছাড়া খালিজ টাইমস-এও আলিয়ার একজন ছাত্রী কাজ করছেন। আর ইংরেজিতে যে মুসলিম পোর্টালগুলি রয়েছে– যেমন ‘টু সার্কেল ডট নেট’– ‘মুসলিম মিরর’ প্রভৃতিতেও আলিয়ার ছাত্রছাত্রীরা লিখে থাকেন। ম্যাডাম কাইফিয়া অবশ্য তাঁদের নাম উল্লেখ করলেন না। ‘পুবের কলম’-এর প্রতিনিধি তাঁকে বলেন– এই পোর্টালগুলি আমরা প্রতিদিনই ফলো করে থাকি। কলকাতার ইংরেজি বা বাংলা পত্রপত্রিকায় যে সংখ্যালঘু উপস্থিতি খুব একটা নেই– তা স্বীকার করে ম্যাডাম কাইফিয়া বলেন– বিশেষ পরিস্থিতির জন্য কলকাতা ও পশ্চিমবাংলায় সংখ্যালঘু সাংবাদিকতার এই দশা। ম্যাডাম কাইফিয়াকে বলা হয় যে– প্রচুর অমুসলিম ছেলেমেয়ে ‘পুবের কলম’ পত্রিকায় কাজের আবেদন নিয়ে আসে। কিন্তু মুসলিম ছেলেমেয়ে একেবারেই দেখা যায় না। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও কেউ আসে না। এ সম্পর্কে দুঃখ করে অধ্যাপিকা ড. কাইফিয়া বলেন– দেখা যায় মুসলিম ছেলেমেয়েরা সাংবাদিকতা করার জন্য যাদবপুর– কলকাতা– বিশ্বভারতী– বারাসত সব জায়গায় যাচ্ছে। কিন্তু তারা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চায় না।
আলিয়ার সাংবাদিকতা বিভাগের এত দুরবস্থা কেন? রিয়াজ সাহেব নিজেই বললেন– হ্যাঁ– বাংলা– ইংরেজি– ইতিহাস– আরবি– ভূগোল প্রভৃতি বিভাগে তো পডYয়াদের ছড়াছড়ি। সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের এই খরা কাটানোর জন্য বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আপনি কী ভাবছেন? ড. রিয়াজ বললেন– এ বিষয়ে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা সম্পূর্ণ কর্তৃপক্ষের হাতে। তারা বিজ্ঞাপনের জন্য সামান্য অর্থ নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ফলে খুব বেশি বিজ্ঞাপনও করা যায় না। ড. রিয়াজকে বলা হয়েছিল– সাংবাদিকতা বিভাগের প্রচারের জন্য তো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারে। স্ন্যাপ ও বেসের মতো সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও খানিকটা লাভ হতে পারে। পড়ুয়া সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তো আরও পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। রিয়াজ সাহেব উত্তরে বলেন– সেগুলি অবশ্য ভাবা যেতে পারে।
প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। যেখানে আলিয়ার অন্য সমস্ত বিভাগে ছাত্রছাত্রী ভর্তির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা চলে– যেখানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়– কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে আসন পাওয়াই দুরূহ। সেখানে আমাদের গর্বের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হাল কেন? অধ্যাপক– সুন্দর ভবন– আনুষঙ্গিক পরিবেশ সবই তো রয়েছে। কোনও বিভাগে টিকে থাকা ৫-৬ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য তিন-তিনজন প্রফেসর! ‘রেশিও’ হিসেব করলে তো রীতিমতো চমকে উঠতে হয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাসম্পন্ন জ্ঞানী অধ্যাপকরা কি পড়ুয়া বৃদ্ধির জন্য কোনও পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন না? রিয়াজ সাহেব বললেন– তাঁর আশা এ বছর হয়তো সাংবাদিকতা বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। কথাটি হয়তো ঠিক। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে ছাত্রছাত্রী বৃদ্ধির জন্য বেসরকারিভাবে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবছর চেষ্টা করেছে। ফলে আবেদন প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ভারতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সাংবাদিকতার গুরুত্ব কি– তা সচেতন কোনও মানুষকে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। সেক্ষেত্রে বাংলার মুসলিমদের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রত্যাশা ছিল– পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি সাংবাদিক তৈরিতে তারা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। দুঃখের কথা– এক্ষেত্রে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন-তিনজন অধ্যাপক থাকলেও সাংবাদিক তৈরিতে আলিয়ার এই বিভাগ তেমন কোনও ভূমিকা আজ পর্যন্ত রাখতে পারেননি বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ আমাদের কিন্তু সাংবাদিক প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু সমাজের অধিকার অর্জন ও ভাবমূর্তি তৈরি করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
আলিয়ার জার্নালিজম ও মাস কমিউনিকেশন বিভাগের এই দুরবস্থার বিষয়টি সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও লক্ষ করেছেন। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়– সেখানে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া বিভাগে পডYয়াদের আসন সংখ্যা হ্রাস করা হয়েছে। বরাদ্দ আসন সংখ্যা ছিল ৬০– এখন তা কমিয়ে ৪০ করা হয়েছে!
যদি এই করুণ অবস্থা বর্তমান থাকে– তবে ভবিষ্যতে আসন সংখ্যা আরও কমে যাবে কি না– কর্তৃপক্ষ তারও কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না। পশ্চিমবঙ্গের ইংরেজি ও বাংলা সাংবাদিকতায় সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী কারা– তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সুশীল সমাজের খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কথা আমরা এখন আলোচনা করব না। সদ্য আলিয়াতে যে ক’জন ছাত্রছাত্রী মিডিয়া বিভাগে পড়েন– তাঁদের মধ্যে কিছু ছাত্রছাত্রী এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
কিন্তু যেহেতু ধরাছোঁয়ার মধ্যে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ও মাস কমিউনিকেশন বিভাগটি রয়েছে– তাই আশা করা হচ্ছিল– পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা ভাষার সংবাদপত্রে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি বৃদ্ধিতে আলিয়া অবদান রাখবে। কিন্তু সে আশাকে এখনও ‘দূরঅস্ত’ বলেই বর্ণনা করা উচিত।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সমস্যা সম্পর্কে শীঘ্রই আরও আলোকপাত করা হবে।