পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: অবশেষে শুরু যুদ্ধ বিরতি। দীর্ঘ ৩ ঘন্টা বিলম্বের পর অবশেষে গাজায় শুরু যুদ্ধ বিরতি। তবে এদিন হামাসের নাম প্রকাশের বিলম্বের মধ্যেই গাজায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। পরে হামাস ইসরাইলের তিনজন নারী বন্দীর নাম প্রকাশ করেছে। যাদের যুদ্ধবিরতির চুক্তির আওতায় প্রথম ধাপে মুক্তি দেওয়া হবে। টেলিগ্রামে এক পোস্টে তারা এসব নাম প্রকাশ করে। এরা হলেন রোমি গোনেন, এমিলি দামারি ও ডরন স্টেইনব্রেচার। এদিনের হামলায় মৃত্যু হয়েছে 19 জনের বলেই সূত্রের দাবি।
১৫ মাস পর অবশেষে অমানিশার বুক চিরে ভোর হচ্ছে অবরুদ্ধ গাজায়। এক দুঃস্বপ্নময় রাতের শেষে নতুন দিনের সূর্যের অপেক্ষায় মজলুম ফিলিস্তিনবাসী! আঁধারের আবরণ কেটে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে চলেছেন ‘আল্লাহর রাস্তায় থাকা মুজাহিদরা’। আবারও খুদেদের কোলাহলে মুখরিত হতে চলেছে গাজার রাস্তা-ঘাট। গাজার আকাশে-বাতাসে শোনা যাবে পাখিদের গুঞ্জন। কারণ দীর্ঘ টালবাহানার অবশেষে কার্যকর হল গাজার যুদ্ধবিরতি।তিন ঘণ্টা বিলম্বের পর অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। হামাস প্রথম দফায় তিনজন বন্দীকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণার পরই এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
এর কিছুক্ষণ পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় গাজার স্থানীয় সময় সকাল সোয়া ১১টার দিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ঘোষণা দেয়। এর আগে স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩০মিনিটে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হামাস বন্দীদের নাম প্রকাশে দেরি করার কারণে যুদ্ধবিরতি পিছিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, পশ্চিমা বিশ্ব শক্তি, অর্থ, অস্ত্র কাজে লাগিয়েও হামাসকে হারাতে পারল না। গাজা জিতে গেল শেষ পর্যন্ত। এটা শুধু গাজাবাসীরাই বলছেন না। স্বীকার করছে দখলদার ইসরাইলও। গাজায় ইসরাইলের কোনও লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি। উল্টে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে হয়েছে। এতে দেশটির যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকারে ব্যাপক হতাশা দেখা যাচ্ছে।
ইসরাইলি বিদেশমন্ত্রী গিডিয়ন সা’রের বক্তব্যেও সেই হতাশার সুরই শোনা গেছে শনিবার। তিনি বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হামলা চালানো সত্ত্বেও ইসরাইল তার যুদ্ধের লক্ষ্যপূরণ করতে পারেনি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলা শুরুর পরে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত এই যুদ্ধ থামবে না। এরপর প্রায় ১৫ মাস ধরে গাজায় নজিরবিহীন বোমাবর্ষণ চলছে।
এতে হাজার হাজার নিরীহ ও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। ২০ লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পুরো গাজা উপত্যকা কার্যত ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু হামাসকে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর তাই ইসরাইলি নেতাদের গলায় হতাশার সুর। ইসরাইলি বিদেশমন্ত্রী বলেন, বেশ কয়েক মাস ধরে অভিযান চালানোর পরও আমরা একজন জিম্মিকেও জীবিত মুক্ত করে আনতে পারিনি। এদিকে হিজবুল্লাহ প্রধান নাঈম কাসেম বলেছেন, গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের অবিচল প্রতিরোধের প্রমাণ।
নিরাপত্তা ক্যাবিনেট যুদ্ধবিরতিতে সায় দিলেও পূর্ণাঙ্গ ক্যাবিনেট টালবাহানা চালাচ্ছিল। ৬ ঘণ্টার ম্যারাথন বৈঠক। তীব্র বাদানুবাদ। অবশেষে হামাস প্রদত্ত সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সবুজ সংকেত দেয় নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা। হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধে রক্তগঙ্গা বইছে গাজায়। শহিদ হয়েছেন কমপক্ষে ৪৭ হাজার মানুষ। জান্নাতের পাখির তালিকায় নাম লিখিয়েছে প্রায় ১৮ হাজার নিষ্পাপ শিশু।
তবে যুদ্ধবিরতির পর এবার এই মৃত্যুমিছিল থামার আশা করছে আন্তর্জাতিক মহল। অন্যদিকে, প্রায় দেড় বছর পর পণবন্দিদের ঘরে ফেরার আশায় বুক বেঁধেছে তাঁদের পরিবার। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে যেতে সম্মত ছিলেন না নেতানিয়াহুর মন্ত্রীসভার একাধিক সদস্য। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইটামার বেন গাভির এই চুক্তি কার্যকর করা হলে পদত্যাগেরও হুঁশিয়ারি দেন।
মোট ৮ জন যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিপক্ষে ভোট দেন। তবে বিরোধিতা সত্ত্বেও ২৪ জন মন্ত্রী সম্মতি জানানোয় শেষ পর্যন্ত এতে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রীসভা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয় ইসরাইল-হামাস সংঘাত। তারপর থেকে যুদ্ধবিরতির জন্য লাগাতার মধ্যস্থতা করছিল কাতার, মিশর, সউদি আরবের মতো একাধিক দেশ। গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের পাশে থাকলেও যুদ্ধবিরতির বৈঠকে নিয়মিত যোগ দিয়েছিল আমেরিকাও। চলতি জানুয়ারি মাসেই মিশরের কায়রোতে আলোচনায় বসে হামাস ও ইসরাইলের প্রতিনিধিরা। দুপক্ষের বৈঠক সদর্থক হয়। তখনই শোনা গিয়েছিল সব ঠিক থাকলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই যুদ্ধে ছেদ পড়তে পারে। স্বাক্ষরিত হতে পারে পণবন্দিদের মুক্তির চুক্তি। শেষ পর্যন্ত তেমনটাই ঘটল। চুক্তি অনুযায়ী, রবিবার থেকেই গাজায় শুরু হবে যুদ্ধবিরতি।
প্রথম দফায় ৭৩৭ জন বন্দিকে মুক্তি
গাজা যুদ্ধবিরতি এবং বন্দিমুক্তি চুক্তির প্রথম কার্যকর ধাপ হিসাবে ৩৩ জন বন্দিমুক্তির বিনিময়ে ৭৩৭ জন ফিলিস্তিনি জেলবন্দিকে মুক্তি দেবে ইসরাইল। এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেদেশের বিচার মন্ত্রক। এদিন বিবৃতি জারি করে জানানো হয়েছে, ‘সরকারের তরফে ৭৩৭ জন জেলবন্দি ও আটক থাকা ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন পাওয়া গিয়েছে।’ তাঁরা বর্তমানে দেশটির কারাগার পরিষেবার অধীনে বন্দি রয়েছেন। আদৌ চলতি সপ্তাহের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা সম্ভব কিনা, সেই বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু, অবশেষে সেই দোলাচল কেটেছে। যে ৭৩৭ জন প্রথম দফায় মুক্তি দেওয়া হবে, তাঁদের মধ্যে নারী, পুরুষ যেমন রয়েছেন, তেমনই নাবালক-নাবালিকারাও রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তবে, রবিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৪টের আগে তাঁরা কেউ মুক্তি পাবেন না।
প্রস্তুত ১ হাজার ৩০০ ত্রাণবাহী ট্রাক
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রবেশের জন্য ১ হাজার ৩০০ ত্রাণবাহী ট্রাক প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের মুখপাত্র রোজালিয়া বোলেন। তিনি সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেছেন, তইউনিসেফের পক্ষ থেকে, ১ হাজার ৩০০ ট্রাক প্রস্তুত। এরপর ত্রাণবাহী আরও ৭০০ ট্রাক গাজায় প্রবেশ করতে পারবে। আমরা একা নই, অন্যান্যরা এসব মানবিক সহায়তা প্রস্তুতে কাজ করছেন।দ ইউনিসেফের এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গাজার অনেক মানুষ উত্তরাঞ্চল থেকে আল-মাওয়াসির দিকে এসেছেন। যখন যুদ্ধবিরতি শুরু হবে, তখন সেখানকার বাসিন্দারা আবারও নিজ বাড়িতে ফেরা শুরু করতে পারেন। বিষয়টি জটিল হবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, এ বিষয়টির সঙ্গে সমন্বয় করে তারা তাদের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চালাবেন।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে ব্রিটেন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটির পার্লামেন্টের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কমিটি। সেই সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের জন্য ইসরাইলের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সবকিছু করার’ আহ্বানও জানানো হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই বিশেষ কমিটি গাজার মানবিক পরিস্থিতি, পশ্চিম তীরের উন্নয়ন এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে কী পদক্ষেপ নেবে সরকারকে অবশ্যই তা নির্ধারণ করতে হবে।’
ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করতে দেওয়া যাবে না: এরদোগান
নেতানিয়াহু সরকারকে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করতে দেওয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। আঙ্কারায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। এরদোগান বলেন, ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু নিহত হওয়ার পরও গাজা আত্মসর্পণ করেনি। তাদের দমন করা যায়নি। গাজাবাসীরা নিপীড়কদের কাছে মাথা নত করেনি। বিশ্বকে গাজার জনগণের প্রতি তাদের আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে ত্রিস্তরীয় যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে। তবে এই যুদ্ধবিরতির চুক্তিকে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার কেউ কেউ রাজি ছিলেন না। তাঁরা একে হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন। বিরোধিতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অবশ্য যুদ্ধবিরতিতেই সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বৈঠকের পর আমেরিকার মধ্যস্থতাকারী ম্যাকগার্ক বলেছেন, এই সম্মতিচুক্তিতে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমরা আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী।