সুতাহাটার ঢেকুয়া ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসার শতবর্ষ উদযাপন
রফিকুল হাসান: পূর্ব মেদিনীপুরের ঢেকুয়া ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসা (উ.মা.) হলদিয়ার কাছে সুতাহাটায় অবস্থিত। এই মাদ্রাসাটি পেরিয়ে এল ১০০ বছর। এই শতবর্ষ উদ্যাপন করার জন্য ঢেকুয়া ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসা তিনদিন ব্যাপী একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শনিবার ছিল অনুষ্ঠানের প্রথম দিন। শতবর্ষ পেরিয়ে আসার অনুষ্ঠান। তাই মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষিকা সবার মধ্যেই ছিল উৎসাহ, উদ্দীপনার ছোঁয়া।
এই মাদ্রাসাটি পঠন-পাঠন বর্তমানে হাইস্কুলের মতো হলেও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠায় প্রধান অবদান হচ্ছে ফুরফুরার পীর দাদা হুজুর আবু বকর সিদ্দিকী রহ.-এর। তিনি নিজেও এই অঞ্চলে এসেছেন এবং তাঁর বিশেষ অনুপ্রেরণায় তাঁর অন্যতম খলিফা আবদুল মাবুদ এখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসাটি বর্তমানে ঢেকুয়া ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসা হিসেবে এলাকায় ভূমিকা রাখছে।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধে প্রধান বক্তা ছিলেন প্রাক্তন সাংসদ, পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক ও পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান। প্রথমে তিনি বলেন, আমি শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য করেই বক্তব্য রাখব। তিনি বলেন, তোমাদের বেগম রোকেয়ার মতো বাংলায় নারী শিক্ষার পথিকৃৎদের কথা জানতে হবে। নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদেরকে তাঁদের দেখানো পথে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ নয়, শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরামর্শ দিলেন আহমদ হাসান ইমরান।
প্রথম তিনদিনের অনুষ্ঠানই শেষ নয়। সারা বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক মাদ্রাসার শতবর্ষ পালন করা হবে। এ কথা জানিয়েছেন ঢেকুয়া ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষিকা নাফিসা খাতুন। এদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার জন্য রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯২৬ সাল থেকে এই মাদ্রাসার পথ চলা শুরু হয়ে প্রথমে খারেজি মাদ্রাসার পর জুনিয়র মাদ্রাসা, তারপর হাই মাদ্রাসা ও বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিকস্তরে উন্নীত হয়েছে। মাদ্রাসায় লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, বিজ্ঞান ও কলা বিভাগ, প্রাথমিক বিভাগ ও ভোকেশনাল বিভাগের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রদান করা হয়। আমাদের মাদ্রাসায় বহু হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে চলেছে। যা আমাদের কাছে একটা গর্বের।
বক্তব্য রাখতে গিয়ে আহমদ হাসান ইমরান আরও বলেন, কোনও প্রতিষ্ঠানের ১০০ বছর অতিক্রান্ত করা সহজ কথা নয়। ফুরফুরার পীর দাদা হুজুরের আর্শীবাদধন্য এই মাদ্রাসার একটি গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। এই এলাকায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে মাদ্রাসাটি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এখান থেকে বহু ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে সমাজে বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী লেখক ও বাণী প্রকাশের প্রতিষ্ঠাতা এস. এম. আখতার হোসেন, লেখক ও ইতিহাসবিদ আমিনুল ইসলাম, বিজ্ঞানী ফারুক আহমেদ প্রমুখ। এই এলাকায় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে ফারুকিয়া হাই মাদ্রাসা উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে।
ইমরান আরও বলেন, এই বাংলা, অসম ও বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে বেগম রোকেয়া শিক্ষা আন্দোলন করেছিলেন। তিনি হিজাব কখনও ত্যাগ করেননি। বেগম রোকেয়ার জন্য তাঁর হিজাব (মস্তক ও বক্ষ আবরণী) কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলে মন্তব্য করেন জনাব ইমরান। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আজকাল মুসলিম মেয়েরা শালীনতা বজায় রেখে হিজাব পরতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি বলেন, হিজাব পরা মুসলিম মেয়েরা বলে থাকে ‘ইউ কভার আওয়ার হেড, নট আওয়ার ব্রেন’। অর্থাৎ আমরা হিজাব দ্বারা মাথা ঢাকি কিন্তু আমাদের মগজ-মস্তিষ্ক তাতে ঢেকে যায় না। ইদানিং আমাদের দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছে। যারা এই বিভেদ করছেন তাঁরা দেশের শত্রু বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই মাদ্রাসায় প্রচুর হিন্দু শিক্ষক আছেন। কমলেশ ঘোড়া, শিক্ষিকা উমা পাত্র, সুমনা মাইতিরা পড়াশুনা করাচ্ছেন। তারপরেও কেউ বা কারা মাদ্রাসা শিক্ষাকে কালিমালিপ্ত করতে সচেষ্ট।
ইমরান আরও বলেন, এই মাদ্রাসায় ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তাদের জন্য কোনও হস্টেল নেই। জমি থাকলে ছাত্রীদের জন্য হস্টেল তৈরিতে ইনশাল্লাহ বাধা হবে না। ইমরান তাঁর লেখা দু’টি বই ‘প্রফেট মুহাম্মদ সা. জীবনচরিত বনাম সমালোচনার যৌক্তিকতা’ এবং ‘বেগম রোকেয়া’ প্রধান শিক্ষিকা নাফিসা খাতুনের হাতে লাইব্রেরির জন্য তুলে দেন।
এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আমিনুল ইসলাম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিতব্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বই জনাব ইমরানকে আগাম উপহার দেন। বই দু’টির নাম ‘পলাশী উত্তর বঙ্গীয় সমাজ ও সংস্কূতি’ এবং ‘জাতীয়তাবাদn রেনেসাঁ চেতনা বাঙালি মন’। সকালে অনুষ্ঠানের প্রথম পর্যায়ের উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা পর্ষদের সভাপতি ড. আবু তাহের কামরুদ্দিন। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিকতা উপস্থিত বিদ্বজ্জনের কাছে তুলে ধরেন।