বিশেষ প্রতিববা: সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় একটি প্রচার অভিযান শুরু হয়েছে যে, বাংলাদেশী মুসলিম নাগরিকদের যেন এই দুই রাজ্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া না হয়। কারণ, শেখ হাসিনার অবর্তমানে বাংলাদেশীদের কেউ কেউ ভারতের তেরঙ্গা পতাকার অবমাননা করছে।
হিন্দু বাংলাদেশীদের উপর নির্মম অত্যাচার করছে। তাই বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা এখনে বহালতবিয়তে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা পাবে, তা হবে না।
বোঝা যাচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের আস্থার অভাব লক্ষ্য করা গেছে প্রথম থেকেই। আসলে সদ্য সদ্য রাষ্ট্রীয় নির্বাচনে হাসিনা ও আওয়ামি লিগের বিশাল বিজয়ের ঠিক পরেই হাসিনা এমনভাবে বিদায় নেবেন, এটা নয়াদিল্লি আশা করেনি। বলতেই হবে, এটা নয়াদিল্লির বিদেশ মন্ত্রকের ব্যর্থতা।
সে যাইহোক, একটু সামলে উঠে ভারতের বিদেশ দফতর এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশে যে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, তার উপর নয়াদিল্লির আস্থা নেই। ভারতের বিদেশ দফতর ঘোষণা করে, প্রতিবেশি বাংলাদেশীদের জন্য ভারতের ভিসা প্রদান আপাতত বন্ধ থাকবে। শুধুমাত্র চিকিৎসা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভিসা দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘পিপল টু পিপল’ কানেকশনের প্রতি এতদিন যে জোর দেওয়া হত সেই ভীতটাই নষ্ট হওয়ার মুখে এসে দাঁড়াল।
এছাড়া ভারতের মিডিয়ায় যে প্রচন্ড বাংলাদেশ বিরোধিতা শুরু হয়েছে তা পাকিস্তান বিরোধিতাকেও বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে। পরে অবশ্য জানা গেছে, উভয় দেশের মিডিয়াই অনেক কথা অতিরঞ্জিত করে পেশ করছে। কিন্তু ’৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সম্ভবত দু’দেশের মধ্যে এত খারাপ সম্পর্ক আগে কখনও হয়নি।
অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাংলাদেশের প্রতিবেশি দুই বাংলাভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার হাসপাতালগুলি ঘোষণা করে দিয়েছে তারা কোনও বাংলাদেশী রোগীর চিকিৎসা করবে না। এই খবর প্রথমে আসে উত্তর কলকাতার জেএন রায় হাসপাতাল থেকে। এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাংলাদেশী নাগরিকরা ভারতীয় পতাকার অপমান করেছে। তাই তারা রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এখন থেকে তাঁরা কোনও বাংলাদেশী পুুরুষ, মহিলা বা শিশুর চিকিৎসা তাঁদের হাসপাতালে করবেন না।
এই হাসপাতালের এক আধিকারিক শুভ্রাংশু ভক্ত এখানেই থেমে নেই, তিনি সিটি অফ জয়ের অন্য সকল হাসপাতালের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তারাও যেন বাংলাদেশীদের প্রতি একই পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাতে বাংলাদেশী হিন্দুদের প্রতি কথিত নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানো যায়। শুভ্রাংশু ভক্ত আরও বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু তাও ভারত বিরোধী মনোভাব নিয়েছে বাংলাদেশীরা।
পুবের কলম পত্রিকার তরফ থেকে ওই হাসপাতালে ফোন করা হলে সজল ঘোষ নামে কর্তৃপক্ষের একজন কথা বলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, চিকিৎসকদের তো শপথ রয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সেবা করবেন, তাঁদের চিকিৎসা দেবেন। সজলবাবুর জবাব ছিল, এই শপথ তো চিকিৎসকরা নিয়েছেন। আমরা যারা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ আমরা তো এই শপথ নিইনি। কাজেই ডাক্তারদের এই শপথ আমাদের প্রতি প্রযোজ্য নয়। তিনি জানান, বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক থাকাকালীন জেএন রায় হাসপাতাল কিছু বাংলাদেশী রোগীও পেত।
এদিকে জেএন রায় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের আহ্বান, বাংলাদেশী রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা যাবে না এবং অন্য হাসপাতালগুলিরও এই ঘোষণা মোতাবেক চলা উচিত। তা কলকাতার আর কোনও কোনও হাসপাতাল গ্রহণ করেছে, তা নিয়ে এখনও তথ্য সংগ্রহ চলছে।
কিন্তু ভারতের আর একটি রাজ্য ত্রিপুরার হাসপাতালগুলি বাংলাদেশী রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। আগরতলা ভিত্তিক আইএলএস হাসপাতাল বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে বাংলাদেশী নাগরিকদের আগরতলায় মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছে।
সীমান্ত জেলার বাংলাদেশী রোগীরা ত্রিপুরায় চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার জন্য আসতেন। কিন্তু তা এখন বন্ধ করে দেওয়া হল। বাংলাদেশী রোগীদের জন্য আখুরা বর্ডারে রিসিভ করার উদ্দেশে আমাদের যে রিসেপশন ও সহায়তা কেন্দ্র ছিল তা আমরা বন্ধ করে দিলাম, জানালেন আইএলএস হাসপাতালের অন্যতম কর্তৃপক্ষ গৌতম হাজারিকা। তিনি বলেন, আমরা ত্রিপুরার অন্য হাসপাতালগুলিকেও একই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি।
সাংবাদিকরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, যদি বাংলাদেশী হিন্দু নাগরিকরা ত্রিপুরায় চিকিৎসা পরিষেবা চান, সেক্ষেত্রে কি হবে? গৌতম হাজারিকা বলেন, বাংলাদেশী হিন্দুরা সব সময় ভারতে স্বাগত।
বন্ধু ও সহোদর প্রতীম বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এই চরম দিকে মোড় নেবে তা কেউ হয়তো চিন্তা করতে পারেননি। কিন্তু তাই হয়েছে এবং প্রতিদিন অবস্থা আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
তবে এর অন্য একটি দিকও আছে। তাহল বাংলাদেশে রোগীদের মুখ চেয়ে কলকাতায় বিশেষ করে বাইপাস অঞ্চলে বেশকিছু হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে রয়েছে পিয়ারলেস, মনিপাল, অ্যাপোলো ইত্যাদি। এই হাসপাতালগুলিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশী রোগীদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ভাড়াবাড়ি, রেস্টুরেন্ট প্রভৃতিও গড়ে উঠেছে। কলকাতার সদর স্ট্রিট, জাকারিয়া স্ট্রিট, প্রভৃতি অঞ্চলে যে কয়েক শত ছোট-বড় হোটেল রয়েছে, ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা এখন খাঁ খাঁ করছে।
ফলে কলকাতার অর্থনীতিতেও এর একটি চাপ পড়েছে। এছাড়া একটি কথা আছে, কোনও স্থানই বেশিদিন শূন্য থাকে না। বাংলাদেশী ট্যুরিস্টরা এখন বেড়ানোর জন্য নেপাল, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশকে বেছে নিচ্ছেন। অন্যদিকে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য বাংলাদেশীরা এখন পা বাড়াতে শুরু করেছেন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি রাষ্ট্রের দিকে।
শিক্ষাক্ষেত্রেও তাই। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশীদের চিকিৎসা-পর্যটনের প্রয়োজন মেটাতে হাসপাতাল ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নতুন পরিকাঠামো ও পরিষেবা গড়ে তোলা হচ্ছে। এর ফলে আখেরে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার অর্থনীতিতেও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের মতোই পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা বাংলাভাষী রাজ্য। এক্ষেত্রে বড় ধরনের ফারাক বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষতি করবে বলে অনেকে মনে করছেন।