পুবের কলম প্রতিবেদকঃ হাম কাগজ নাহি দিখায়েঙ্গে… বছর কয়েক আগে এই স্লোগানের সঙ্গে গর্জে উঠেছিল দেশ। সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছিল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সেই সময় বহু মুসলিম নাগরিককে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ পেশ করতে বলে হেনস্থা করা হয়েছিল। নিজের বাপ-দাদার দেশ, নিজের প্রিয় জন্মভূমি যেখানে শত শত বছর ধরছে বাস করছে হি¨ু-মুসলিম নাগরিকরা, সেখানেই কি না নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে ‘কাগজ’ দেখিয়ে! ভারতবাসী তাই সোচ্চার কণ্ঠে বলেছিল ‘কাগজ আমরা দেখাব না’। এই আ¨োলনে প্রথম সারিতে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। সেই বাংলাতেই সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যাতে অশনিসংকেত দেখছেন অনেকেই। নোবেলজয়ী প্রফেসর অমর্ত্য সেনের ‘প্রতীচী’ ট্রাস্টের গবেষক সাবির আহমেদকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে বলে বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালল কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ (চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল)। সমাজের পিছিয়েপড়া, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করে ‘প্রতীচী’। তাই কর্মসংস্থান-শিক্ষায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজনের প্রতিনিধিত্ব বা পরিসংখ্যান জানতে মাঝেমধ্যেই তথ্য জানার অধিকার আইনে কেস ফাইল করেন গবেষক সাবির আহমেদ। তিনি সম্প্রতি রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলিতে এসসি, এসটি, ওবিসি, জেনারেল ও সংখ্যালঘু ফ্যাকাল্টি, প্রশাসনিক অফিসার ও কলেজ-হাসপাতাল কমিটির সদস্যদের বিষয়ে জানতে চেয়ে আরটিআই করেছিলেন। কোন সামাজিক গ্রুপ, ক-জন মহিলা, ক-জন পুরুষ, তাদের বয়স, তারা কোন পদে কাজ করেন ইত্যাদি বিষয়ে তিনি জানতে চেয়ে ২৮টি প্রতিষ্ঠানের জন্য আরটিআই করলে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান তার জবাব দিয়েছে। তার মধ্যে অবাক করার মতো বিষয় ঘটেছে এনআরএস ও চিত্তরঞ্জনে। তারা সাবির আহমেদের প্রশ্নের জবাব তো দেয়ইনি, উলটে তার নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
অন্যদিকে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ জানিয়েছে, এ ধরনের তথ্য দিলে তা স্টাফদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং তাদের সংহতির ক্ষতি হতে পারে! জন্মভূমি ভারত তথা বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে এভাবে নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে বলা হবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি সাবির আহমেদ। তিনি জানাচ্ছেন, আমি গবেষক হিসেবে ইতিপূর্বে আড়াই হাজারের বেশি আরটিআই আবেদন করেছি রাজ্য ও কেন্দ্রের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে। এই প্রথম আমাকে ভারতীয় ‘সিটিজেনশিপ’-এর প্রমাণ দেখাতে বলা হল। এ ধরনের কোনও নিয়ম-নীতি কিন্তু আরটিআই অ্যাক্ট, ২০০৫-এ নেই।
সাবির আহমেদের আরটিআই আবেদনের প্রেক্ষিতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার জানিয়েছেন, আপনি যে ভারতের নাগরিক তার কোনও ঘোষণা দেননি আরটিআই অ্যাপ্লিকেশনে। তাই আমরা আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না। যতক্ষণ না নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখানো হবে, ততক্ষণ কোনও জবাব দেওয়া হবে বলে না জানিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। এর পর পরই সাবির আহমেদ তার আধার কার্ডের ফটোকপি ওই অফিসারকে পাঠিয়ে দেন। তখন কর্তৃপক্ষ জানায়, গবেষক হিসেবে সাবির আহমেদকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা হবে। তবে আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নয়! অর্থাৎ, সাবিরের নাগরিকত্ব নিয়ে বার বার স¨েহ প্রকাশ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সাবির আহমেদের প্রশ্ন, ওরা কি বলতে চাইছে আমি ভারতীয় নাগরিক নই! নাকি স¨েহ করছে? সাবির মুসলিম বলেই কি এই ধরনের আচরণ! আর কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষগুলি প্রশ্ন বুঝতে পারছে না, এটাও হাস্যকর অজুহাত ছাড়া কিছুই নয়। এ ছাড়া রাজ্যের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আরটিআই আবেদনে সাড়াই দেয়নি। যেমন— কলকাতার পিজি, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজ। তারা তথ্য কেন আড়াল করতে চাইছে, সেই প্রশ্নও উঠছে।