আহমদ হাসান ইমরান : রাঙামাটির জেলা বীরভূম। মুসলিমরা এই জেলায় প্রায় ৩৮ শতাংশ (২০১১ সেনসাস)। বীরভূমে রয়েছে রাজনগরের স্বাধীনতা সংগ্রামী লালবিধি-র ঐতিহ্য। এই বীরভূমে কিন্তু অনেক জায়গাতেই সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থা ভাল নয়। বহু জায়গাতেই তাদের এখনও মাটির তৈরি আধ-ভাঙা বাড়িতেই থাকতে হয়। রোজগারের পথও তেমন কিছু নেই। রয়েছে পাথর ও বালির খাদান। সেখানে দিনমজুরের কাজ করেন অনেকেই। আর পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে নানা রোগে ভোগেন তারা। এইসব এলাকার বাসিন্দাদের তাই পেটের ভাতের জন্য তীব্র সংগ্রাম করতে হয়। আর সর্বেসর্বা রাজনীতিবিদ্দের কাছে হাত পাততে হয়, তাদের কথামতো চলতে হয়। বীরভূমের নানুর কিংবা বগটুইতে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, তার পিছনে রাজনীতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক আধিপত্যের লড়াই। আর তারই শিকার হন গরীর মানুষগুলি। কিন্তু তাদের কাছে রোজগারের পথ কোথায়!
মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, দুই ২৪ পরগনার সংখ্যালঘুরা রুজির খোঁজে পাড়ি দেন ভিন রাজ্যে। তারা চলে যান কেরল, দিল্লি, সুরাট, আহমদাবাদ, মুম্বই্, তামিলনাডু, হরিয়ানা বা পঞ্জাবে। ইদানিং কিছু বাঙালি মুসলিম দুবাই, সউদি আরব ও মালয়েশিয়া প্রভৃতি ভিন দেশেও রোজগারের তাড়নায় চলে যাচ্ছেন।
কিন্তু বীরভূমের দরিদ্র সংখ্যালঘুদের মধ্যে দেশান্তরে যাওয়ার খুব এতটা প্রবণতা নেই। তাই তাদেরকে ‘বদ্ধ ঘরে’ থেকেই পরিবারের জন্য অন্নের সন্ধান করতে হয়। আর তারই সুযোগ নেন ভোটকারবারী মাফিয়ারা। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া প্রভৃতি জেলার গরিব মুসলিমরা বিড়ি বেঁধে, জরির কাজ করে বা মুড়ি ভেজে ধীরে ধীরে অবস্থার খানিকটা হলেও পরিবর্তন করেছে। কিন্তু বীরভূমে এই ধরনের কোনও কুটির শিল্প গড়ে ওঠেনি। আর ভারী শিল্পের তো কথাই নেই। বর্ধমানে মতো চাষবাসের মাটিও সেখানে খুব উর্বর নয়।
অন্যদের কথা বাদ দিলেও যেসব মুসলিম শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ইদানিং উঠে এসেছেন, তাঁরাও কিন্তু বীরভূমের দিকে খুব একটা নজর দেননি বা নজর দেওয়ার মতো পরিবেশ পরিস্থিতি পাননি। তাই সেই পুরনো খাদান কেন্দ্রিক অর্থনীতিতেই নির্ভর করতে হচ্ছে এইসব মানুষদের। আর সেইজন্য বীরভূমের গরিব সংখ্যালঘুদের খুন-খারাবীতে ব্যবহার করা খুবই সহজ। ইদানিং অবশ্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে ছেলে-মেয়েরা ভাল রেজাল্টও করছে।
এছাড়া বীরভূমের বেশ কিছু এলাকার গ্রামে সামাজিক উন্নতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রসারেও খুব বেশি মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বীরভূমের ওইসব এলাকায় মুসলিমদের নামগুলি থেকেও আন্দাজ করা যায়, ইসলামী জীবনবোধের প্রসারে মাওলানা, সমাজকর্মীরা খুব একটা তৎপর নয়। তাই তাদের নাম ভাদু শেখ, মিহিলাল শেখ, হাজু শেখ ইত্যাদি। কিন্তু এত দারিদ্র ও অব্যবস্থার মধ্যেও বীরভূমের এই সংখ্যালঘুরা নিজেদের আইডেনটিটি ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন প্রয়োজন এই মানুষগুলির জন্য রুজিরোজগারের পথ খুলে দেওয়ার মতো প্রকল্প, আরও বেশি সংখ্যায় স্কুল-মাদ্রাসা-মিশন, সমাজকর্মীদের সহযোগিতা। সেইরকম দিন এলে তবেই হয়তো বীরভূমের বেশ কিছু অঞ্চলের অধিবাসীরা ‘রুদ্ধ দশা’ থেকে মুক্তি পাবে।