পরাজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ব্রিটেনের
আহমদ হাসান ইমরান: শিশু ও নারী হত্যাকারী যায়নবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি লাগু করতে নানা ধানাই-পানাই করছিলেন। পশ্চিমা ও ইহুদি মিডিয়ার কল্যাণে সারা বিশ্বের মানুষের ধারণা ছিল, ইসরাইলি সেনা, বিমানবাহিনী, ক্ষেপণাস্ত্র ও নিষিদ্ধ রাসায়নিক বোমা গাজার হামাস ও ইসলামী জিহাদের প্রতিরোধ শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দিয়েছে। ধ্বংস করে দিয়েছে গাজার হাসপাতাল থেকে শুরু করে পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা এবং দৃশ্যমান সমস্ত পরিকাঠামো। তারা হত্যা করেছে হামাসের সমস্ত প্রধানকে। তাই ইসরাইলি সেনারা হয়তো গাজা সম্পূর্ণ দখল করে নেবে এবং যায়নবাদী ইহুদিদের ‘ইরেজ ইসরাইল’ বা বৃহত্তর ইসরাইলের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার দিকে অগ্রসর হবে।
কিন্তু অন্য কেউ না জানলেও ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ ভালোভাবেই জানত, এত ক্ষয় ক্ষতির পরও হামাস শেষ হয়ে যায়নি। হামাসের লড়াকুরা যে কোনও মুহূর্তে যেন আসমান থেকে আবির্ভূত হয়ে চুক্তির আগে পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর অগ্রসরমান সেনাদের হত্যা করে যাচ্ছিল। ফলে ইসরাইলি সেনারা কোনও সময়ই গাজায় ঠিকমতো অবস্থান মজবুত করতে পারছিল না। আরও আশ্চর্যের কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ইসরাইলের অভেদ্য মেরকোভা ট্যাঙ্কগুলি একের পর এক সেনা-সহ নিকেশ করছিল। আর গাজাকে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেও মাটির নীচে হামাসের ইঞ্জিনিয়াররা যে ভূগর্ভস্থ শহর ও অন্তহীন সূড়ঙ্গ গড়ে তুলেছিল, ইসরাইল নানা মারণাস্ত্র ব্যবহার করেও তার খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। অনেক পশ্চিমা মিডিয়াও স্বীকার করেছে, লোকসান সহ্য করেও হামাস তার আক্রমণের শক্তিকে অনেকটাই অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামাসের কাছে বন্দি ইসরাইলিদের একজন কেও উদ্ধার করতে পারেনি। তাদের সমস্ত প্রযুক্তি এবং শক্তি বৃথা গেছে। সব থেকে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এক বছর তিন মাস শুধু পরমাণু বোমা ছাড়া আর বিশ্বে মওজুদ সমস্ত ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করেও তারা হামাসকে পরাজিত করতে পারেনি। এর থেকে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে! এদিকে একের পর এক কফিনে বন্দি হয়ে ফিরে আসছিল ইহুদি সেনাদের লাশ। ‘টাইমস অফ ইসরাইল’ জানাচ্ছে, ইসরাইলি সেনা ও পুলিশ-সহ ৯০৯ জন সেনা গাজা যুদ্ধে নিহত হয়েছে। ইসরাইল সৃষ্টির পর যেকোনও যুদ্ধে এটাই তাদের সবথেকে বেশি ক্ষতি। আর মানসিক ও শারীরিকভাবে আহতের সংখ্যা প্রায় ৫,০০০-এর মতো বলে কোনও কোনও সংবাদসূত্র জানাচ্ছে। ৯০৯ জন নিহতের যে সংখ্যা ইসরাইল দিচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে বহু সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। এর মধ্যে ইসরাইলেরও কিছু গণমাধ্যম এই পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ইসরাইলি সৈন্য লড়াই করতে করতে ক্লান্ত, হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। নিরীহ নারী ও শিশুদের হত্যা করার ক্ষেত্রেও কিছু বিবেকবান সেনাদের আপত্তি ছিল। অনেকেই চাইছিল, লড়াই থেকে অব্যাহতি। ইসরাইলের অস্ত্র ভান্ডারও শেষ হয়ে আসছিল। যদিও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিমান, বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক যা কিছুই ইসরাইলের ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছিল তা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করে দিচ্ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে মাটির নীচে হামাসের অস্ত্র সরবরাহের সব পথ আমেরিকা ও ইসরাইল বন্ধ করে দিয়েছিল। এ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর এক হামাস নেতা বলেছিলেন, আমরা লড়ছি আল্লাহর মদদে এবং ঈমানী শক্তিতে। সব অবস্থায় লড়াই জারি থাকবে। আর একটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। ইসরাইলকে অর্থ, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বিধ্বংসী হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছিল ইউরোপ, আমেরিকার কমপক্ষে ৩০টি শক্তিশালী দেশ। আর গাজার সাহায্যে এগিয়ে আসা দূরে থাকুক বরং ইসরাইলকে সহায়তা দিচ্ছিল সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডন, মিশর প্রভৃতি আরব দেশ। হামাসকে নৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে শিয়া প্রধান দেশগুলি। এদের মধ্যে রয়েছে ইরান, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাক ও সিরিয়ার প্রভৃতি কিছু অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী। তাও আল্লাহ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রাখলেন হামাসকে। অবরুদ্ধ গাজার সঙ্গে খুনি ইহুদি-খ্রিস্টানবাহিনী সন্ধিচুক্তি করতে বাধ্য হল। ইতিহাসে এই ধরনের বিজয় ও সাফল্যের খুব বেশি নজির নেই।
আজ সকাল ৮টা ৩০ মিনিট থেকে শান্তিচুক্তি লাগু হওয়ার কথা। ইসরাইল কিন্তু তার আগে পর্যন্ত গাজায় হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে। আজ সকাল ৮টা ৩০ মিনিটেও যদি তারা কোনও চাতুরি করে তবে সারা বিশ্বের কাছে যায়নবাদীদের মুখোশ আরও বেশি করে খসে পড়বে এবং ভয়ংকর এক পরিণামের দিকে যে ইসরাইলকে নিয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। হামাসের এই জয় মানবতার জয়, জুলুমকে প্রতিহত করার জয়, ঈমানী শক্তির জয় এবং ইনসাফের এক নজির বিহীন বিজয়।