কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী: কলকাতার পুরসভার নির্বাচিত মেয়র পদের শততম বর্ষ শুরু হয়েছে। প্রথম নির্বাচিত মেয়র ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি এই পদে নির্বাচিত হন ১৯২৩ সালের ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট-এর ভিত্তিতে ১৯২৪ সালে। তিনি ওই পদে শপথ নেন ১৬ এপ্রিল ১৯২৪। পদ থেকে অবসর নেন ১৬ জুলাই ১৯২৫ সালে। অর্থাৎ মেয়র পদে তাঁর মেয়াদ ছিল ১ বছর ৯১ দিন। তাঁর চিফ এক্সিকিউটিভ ছিলেন নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু। ২০২৪-২৫ সালে মেয়র পদে অভিষিক্ত রয়েছেন জনাব ফিরহাদ হাকিম। যিনি ববি হাকিম নামেও পরিচিত।
কলকাতা পুরসভা তথা কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এর জন্ম বৃত্তান্ত দেখলে অবাক হতে হয়। এই পুরসভার মেয়র এক সময় একাধারে শহরের উন্নয়নের আধিকারিকের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তবে তখন কেউই নির্বাচিত মেয়র ছিলেন না। ফোর্ট উইলিয়াম থেকেই প্রথমেই মেয়র নিযুক্ত হত। যদিও মেয়র পারিষদে কিছু স্বদেশী মানুষ নিযুক্ত হতেন। ১৯২৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রথম মেয়র-সহ সব কমিশনার হলেন এদেশের মানুষ। কলকাতা পুরসভায় চালু হল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ছিলেন বাংলার স্থানীয় সেলফ গভর্নমেন্টের ‘প্রথম মন্ত্রী’। ১৯২৩ সালের আইনে মহিলাদেরও ভোটাধিকার প্রদান করা হয়।
এ পর্যন্ত কলকাতা পুরসভার দায়িত্ব পালন করেছেন ৩৮ জন মেয়র। দেশবন্ধু ছাড়া আর যারা এই দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন জ্যোতিন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, সুভাসচন্দ্র বসু, বিধান রায়, এ কে ফজলুল হক, ত্রিগুনা সেন, সৈয়দ বদরুদ্দোজা-র মত দেশ তথা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত ব্যক্তিত্বরা। যদিও কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি তৈরি হয় ১৮৭৬ সালে। তখন এই পুরসভা নিয়ন্ত্রিত হত ফোর্ট উইলিয়াম থেকে। আর, পুরসভার দায়িত্ব বর্তাত জমিদারদের হাতে।
বাংলার প্রথম স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন দফতরের মন্ত্রী রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন তৈরি করেন ১৯২৩ সালে। ওই আইন বলে তখন মেয়র নির্বাচিত হতেন করদাতাদের ভোটে, একবছর মেয়াদের জন্য। এই নতুন আইনে, নির্বাচনে লড়ে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সর্বসম্মত মেয়র নির্বাচিত হন। আজীবন জাতীয়তাবাদী নেতা দেশবন্ধু কলকাতা পুসভার মেয়র পদে শপথ নিয়ে প্রথম যে বক্তব্য পেশ করেন তা খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশবন্ধু তাঁর প্রথম ভাষনেই কলকাতা কর্পোরেশনের যে পথ নির্দেশ করে দেন, তা আজও পুরসভার মূল চালিকা শক্তি হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। যদিও সময় ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তার কিছু কাটছাট হয়েছে, যুক্ত হয়েছে অনেক কিছুই। বর্তমানে তো কলকাতা পুরসভার ৪০টি দফতর রয়েছে।
চিত্তরঞ্জন দাশ সে দিন পুরসভার নীতি হিসাবে জানিয়ে ছিলেন, দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ণ, ভরতুকির ভিত্তিতে শিক্ষাদান, স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া, শহরবাসীকে সস্তায় খাদ্য, দুধ ও জল সরবরাহ। উন্নত স্যানিটেশন-এর ব্যবস্থার সঙ্গে শহরতলীর উন্নয়ন ও দরিদ্র মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে পুরসভার প্রধান কাজ।
তার আগের ইতিহাসের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ১৭২৬ সালে রয়্যাল চ্যাটার্ডের ভিত্তিতে শহরে প্রথম মেয়র কোর্ট তৈরি হল। তারিখটা ছিল ৪ সেপ্টেম্বর। তখন ছিল ১ জন মেয়র আর ৯ জন অল্ডারম্যান। তাঁরা মূলত মেয়র কোর্টের দায়িত্ব সামলাতেন। অর্থাৎ, তা ছিল মূলত আদালত। মেয়র হতেন কলকাতার কোনও জমিদার।
১৭৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষণা করল। একইসঙ্গে এল নতুন চাটার্ড। যাতে পুরসভাকে শহরের আলো, পানীয় জল সরবরাহের জন্য পুকুর খনন, রাস্তা, নিকাশি নালা তৈরি এবং জঞ্জাল অপসারণের দায়িত্ব দেওয়া হল। বলা যায়, তখন থেকেই শহরে নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার কাজ শুরু করে কলকাতা পুরসভা।
একইসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, আজকের যে ধর্মতলা, ফোর্ট উইলিয়াম তা গড়ে উঠে পলাশির যুদ্ধে সিরাজকে হারিয়ে ব্রিটিশের শাসন ক্ষমতা হাতে পাওয়ার বছর ১৭৫৭ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে। ফলে শহরের দেখভাল, বিস্তার-সহ নাগরিক পরিষেবার গুরুত্ব ক্রমশ বাড়তে লাগল। একইসঙ্গে বিচার ব্যবস্থাও ক্রমশ জরুরি হয়ে পড়ল। অবশ্য তার আগে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৫৬ সালে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করে কলকাতার দখল নিয়েছিলেন। পরে রবার্ট ক্লাইভ পুনরায় কলকাতা দখল করেন।
১৭৯৩ সালের নতুন চাটার্ডে ব্রিটিশরা শহরে বিচার ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে পুসভার কর্তার হাতেই সপে দিলেন সেই দায়িত্ব। পুরকর্তার পদের নাম হল চেয়ারম্যান জাস্টিস অফ পিস। এই চার্টার-এর ভত্তিতেই পুরসভার হাতে সম্পত্তি মূল্যায়ণ তথা কর আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হল। একইসঙ্গে শহরের উন্নয়ন তথা পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে চালু কর হল লটারি ব্যবস্থা। এই লটারির টাকা থেকেই গড়া হয় কলকাতার টাউন হল। এই টাউন হল নির্মিত হয় ১৮১৭ সালে। কলকাতা পুসভার কর্তারা পিস অফ জাস্টিস হিসাবে বিচারক তথা কলকাতা পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৭৯৪ থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শহরে চিকিৎসা পরিষেবার প্রয়োজনীয়তা বাড়তে লাগল। তাই ১৮৮৩ সালে কলকাতা পুরসভায় চালু করা হয় স্বাস্থ্য দফতর। এরপর এল ১৮৭৬ সালের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন আইন। তাতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান-সহ ৭২ কাউন্সিলার থাকার ব্যবস্থা করা হল। যার মধ্যে ২৪ জন থাকবে সরকার মনোনীত সদস্য। আর ১০ জন আসবে চেম্বার অফ কমার্স থেকে।
কলকাতা পুরসভায় স্বদেশী যুগ এল ১৯২৩ সালে। আজকের যে মন্ত্রিসভার ধাঁচে মেয়র পারিষদ ব্যবস্থা তা চালু হয়েছে ১৯৮৪ সালের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অ্যাক্ট অনুয়ায়ী। কলকাতা নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আইন-ই-আকবরীতে। তৎকালীন সময়ের এই এনসাইক্লোপিডিয়াটি তৈরি করেছিলেন সম্রাট আকবরের সভাসদ ও প্রখ্যাত পন্ডিত আবুল ফজল। সেই হিসেবে কলকাতার ইতিহাসে রয়েছে এক লম্বা সময়ের ফিরিস্তি।