রক্তিমা দাস: পুরভোটের প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করলেও মেয়র পদপ্রার্থী ঘোষণা করেনি তৃণমূল কংগ্রেস। এ দিকে কলকাতার পুরভোটে মানুষ সবচেয়ে উদগ্রীব হয়ে থাকেন মেয়র পদপ্রার্থী কে হলেন– তা জানার জন্য। কারণ তাঁর ওপরেই নির্ভর করছে কলকাতার উন্নয়নের ভবিষ্যৎ। এক্ষেত্রে জনগণের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন সদ্য প্রাক্তন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। করোনা থেকে আমফান প্রতিটি দুর্যোগই দক্ষতার সঙ্গে রাস্তায় নেমে সামলেছেন। দলনেত্রীর থেকে তার প্রাপ্য পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ‘এক ব্যক্তি– এক পদ’ নীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে ফের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী করা হয়েছে ফিরহাদ হাকিমকে। এবারেও তাঁর নিজের ওয়ার্ড অর্থাৎ ৮২নং ওয়ার্ড থেকেই লড়ছেন তিনি। তবে ভোট যে দোরগোড়ায়– তাঁর পাড়ায় ঘুরলে তা বোঝার উপায় নেই। কোথাও নেই কোনও দেওয়াল লিখন। কারণ দৃশ্যদূষণ তাঁর পছন্দ নয়। মানুষের রায় পেতে কাজই যথেষ্ট বলে মনে করেন ফিরহাদ হাকিম।
২০১৮ সালে শোভন চট্টোপাধ্যায় আচমকা মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর মেয়র হন ফিরহাদ হাকিম। কিন্তু তিনি কাউন্সিলর ছিলেন না। সংশোধিত পুর আইনে কাউন্সিলর না হয়েও কলকাতা পুরসভার মেয়র হওয়া যায়। তবে শপথগ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে শহরের যে কোনও একটি ওয়ার্ড থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে হবে। সেই নিয়মে ফের পুরভোটে লড়েন ফিরহাদ হাকিম। চেতলার ৮২ নম্বর ওয়ার্ডে শাসকদলের কাউন্সিলর প্রণব বিশ্বাস ইস্তফা দেন। তার জায়গায় ওই ওয়ার্ডে ফিরহাদ হাকিমকে প্রার্থী করে শাসকদল। সেই নির্বাচনে দ্বিগুণেরও বেশি ভোটে জয়ী হন তিনি। কলকাতা পুরসভার মেয়রের আসনে বসেন ফিরহাদ হাকিম।
২০১৮ থেকে ২০২১– এই তিন বছরে ফিরহাদ হাকিমের জামানাতে কলকাতা পুরসভার নাগরিক পরিষেবার ব্যাপক উন্নতি হয় বলে মত বহু শহরবাসীর। বিশেষত কোভিড পরিস্থিতিতে ফিরহাদের নেতৃত্বে পুরপ্রশাসক বোর্ড যেভাবে কাজ করেছে– তা যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। প্রথম করোনা ভ্যাকসিন যখন বাজারে আসে অনেকেই তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ে দূরে থাকছিলেন ভ্যাকসিন থেকে। সেই সময় কলকাতার মহানাগরিক হিসেবে প্রথম টিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ফিরহাদ হাকিম। এরপর আর থামতে হয়নি। টিকার ভীতি দূর হয়েছিল শহর থেকে। করোনার সময় একাধিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টার গড়া থেকে শুরু করে প্রত্যেক শহরবাসীর টিকা দান সম্পন্ন করা– সব কাজেই লক্ষ্যভেদ করেন তিনি।
২০২০ সালে একদিকে বিশ্ব ত্রাস অজানা ভাইরাস করোনা যখন থাবা বসিয়েছে শহরে– সেই সময়ই মহানগরীর ওপর দিয়ে বয়ে যায় আর এক প্রলয়– অতিশক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আমফান। অতিমারির প্রকোপে যখন মৃত্যু মিছিল শহরে– সেই সময়ই সবুজ শহরকে ধূসর করে দিয়ে যায় আমফান। একসঙ্গে দুটি দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সেই সময় মুখের কথা ছিল। এর আগে এই ধরনের দুর্যোগ আগে দেখেনি শহর। ফলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তবে পরিষেবায় কোনও খামতি থাকেনি। করোনা থেকে আমফান প্রতিটি দুর্যোগ সামলাতেই রাস্তায় নেমে পড়েন তৎকালীন মেয়র ফিরহাদ হাকিম।
মেয়র হওয়ার প্রথম শর্তই হল– মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া। কলকাতা পুরসভার মেয়র পদে দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ‘টক টু মেয়র’ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন ফিরহাদ হাকিম। প্রত্যেক শনিবার দুপুর ৩টে থেকে ৪টা– এক ঘণ্টা ফোনে শহরবাসীর যাবতীয় অভাব অভিযোগ শুনতেন ফিরহাদ হাকিম। কর্মসূচিতে তাঁর পাশেই বসে থাকতেন সমস্ত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা। অভিযোগ সরাসরি পৌঁছে দেওয়া হত আধিকারিকদের কাছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই হত সমস্যার সমাধান। পরে পুরবোর্ড ভেঙে যাওয়ার পর ‘টক টু কেএমসি’ নামে এই কর্মসূচি জারি রেখেছিলেন পুরপ্রশাসক ফিরহাদ হাকিম।
এর আগে এত সহজে মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা অন্য কারওর আমলে ছিল না। এই অনুষ্ঠান এতটাই জনপ্রিয় হয় যে– ‘টক টু মেয়র’ বা ‘টক টু কেএমসি’ অনুষ্ঠানে অনেকবারই কলকাতার বাইরেও এই পরিষেবা চালু করার জন্য অনুরোধ এসেছিল রাজ্যবাসীর তরফ থেকে। শুধু তাই নয়– শেষ ‘টক টু কেএমসি’ অনুষ্ঠানে ফিরহাদ হাকিমের কাছে এক অভিনব আর্জি আসে ফোনের ওপার থেকে– সেখানে ফিরহাদ হাকিমকেই আবার মেয়র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন ওই নাগরিক।
তবে এত কিছুর পরেও প্রাথীতালিকা প্রকাশ করেও ভবিষ্যৎ মেয়রের জল্পনা জিইয়ে রেখেছে তৃণমূল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে– ভোটের আগে মেয়র মুখ প্রকাশ না করে– দলের তরফ থেকে এই বার্তা দেওয়া হল যে নির্দিষ্ট কোনও মুখকে সামনে রেখে এগোতে চাইছে না তৃণমূল। যদিও মেয়র কে হচ্ছেন– তা ফুলবাগানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় কিছুটা প্রকাশ হয়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে।
বুধবার জনসভা থেকেই ফিরহাদ হাকিমকে কখনও কলকাতায় বুস্টার পাম্পিং স্টেশন গড়ে দেওয়া– তো কখনও নিম্নবিত্তদের জন্য কমিউনিটি হলের ভাড়ার ৫০ শতাংশে ছাড় দেওয়ার নির্দেশ দেন তৃণমূল সুপ্রিমো। আর এর থেকেই জল্পনা শুরু হয়েছে– তবে কী কলকাতার উন্নয়ন ও নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার দায়িত্ব সেই ফিরহাদ হাকিমের কাঁধেই দিতে চলেছেন দলনেত্রী! যদিও এ প্রসঙ্গে দলের তরফ থেকে কোনও রকম স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তৃণমূলের এক নেতাকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে– তিনি মুচকি হেসে বলেন– ‘সময়ই সব কিছুর উত্তর দেবে।’ ফিরহাদকে বলা হয় ২৪*৭ মেয়র। কারণ তিনি কলকাতা মানুষের প্রয়োজনে সব সময় হাজির হন।