আহমদ হাসান
বৃহস্পতিবার আমরা পালন করলাম ‘ডক্টরস ডে’। চিকিৎসকদের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোর এই দিবসটি প্রকৃতই অসামান্য তাৎপর্য রাখে। একইসঙ্গে পালিত হল ‘বাংলার রূপকার’ ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম ও মৃত্যুদিন। আমরা সকলেই জানি– তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিনকে ‘জাতীয় চিকিৎসক দিবস’ হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ– বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন এক অসাধারণ চিকিৎসক। তাঁর চিকিৎসা খানিকটা কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। তাঁর রোগ নির্ণয় এবং প্রেসক্রিপশন ছিল র*পকথার কাহিনীর মতো। তাঁর ছাত্ররা নিশ্চয়ই তাঁর অভিজ্ঞতা ও প্রতিভা থেকে হয়তো বা উত্তরাধিকার হাসিল করেছেন। যদি ডা. বিধানচন্দ্র রায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর প্রজ্ঞা– দূরদৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনও ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতেন– তাহলে তাঁর চিকিৎসার ধারা ও অর্জন সম্পর্কে পরবর্তীকালে নয়া চিকিৎসক প্রজন্ম উপকৃত হতেন। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি।
এর কারণ হয়তো তাঁর রাজনৈতিক সংযোগ ও তৎপরতা। বিধানচন্দ্র রায় রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদ অলংকৃত করেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি পশ্চিমবাংলার পুর্নগঠনের দিকে নজর দেন। তিনি কল্যাণী– দুর্গাপুর– দিঘার উন্নয়নে– শিল্পের উন্নয়নে যে ভবিষ্যত দৃষ্টি নিয়ে কাজ করেছেন– তা আমরা সকলেই জানি।
ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের চরিত্রের একটি দিক অবশ্য তাঁর ভাবমূর্তির সঙ্গে মানানসই নয়। দেশভাগের পর পরই তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বলা যায়– ফজলুল হক– সোহরাওয়ার্দী ও নাজিমুদ্দীনের বাংলার প্রিমিয়ার বা ‘প্রধানমন্ত্রীর’ কাল শেষ হওয়ার পরই বিধানচন্দ্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় শুরু হয়। মাঝখানে অবশ্য মাত্র ১৬০ দিনের জন্য প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
যেকোনও কারণেই হোক পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই বাংলার নাগরিক ও ভূমিপুত্র মুসলমানদের উৎখাত করে ওপার বাংলায় পাঠাতে খুবই উৎসাহী ছিলেন। অন্নদাশংকর রায় তখন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক। মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে নির্দেশ দেন– মুর্শিদাবাদ থেকে মুসলিম জনসংখ্যা যতটা সম্ভব হ্রাস করতে হবে। তিনি জেলাশাসককে বলেন– এজন্য মুর্শিদাবাদ থেকে মুসলমানদের গণহারে উচ্ছেদ করে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিতে হবে। আদ্যপান্ত সেক্যুলার অন্নদাশংকর রায় মুখ্যমন্ত্রীর এই নির্দেশকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন– ভারতবর্ষ সংবিধান অনুযায়ী এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্টÉ। জোর করে ভারতীয় নাগরিক মুসলমানদের কি অপরাধে এবং কোন আইনে সীমান্তের ওপারে বহিষ্কার করা হবে স্বাভাবিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে এ প্রশ্নের কোনও জবাব ছিল না। কিন্তু তিনি জেদ করতে লাগলেন যে– জেলাশাসক অন্নদাশংকর রায়কে তিনি যে মৌখিক নির্দেশ দিচ্ছেন জেলাশাসককে তা অবশ্যই পালন করতে হবে।
বিধানচন্দ্র রায় এ বিষয়ে কোনও লিখিত নির্দেশ দিতে রাজি হননি। অন্নদাশংকর রায় বুঝে গিয়েছিলেন– মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিবাদ করে তার জেলাশাসকের পদে থাকা যাবে না। এছাড়া একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবেও বাংলার মুসলিমদের উচ্ছেদ করতে তাঁর মন সায় দেয়নি। তিনি জেলাশাসকের পদ থেকে ইস্তফা দেন। ফলে মুর্শিদাবাদ থেকে গণহারে মুসলিম বিতাড়নের প্রক্রিয়া অনেকটা থেমে যায়।
এছাড়া কৈখালি– তৎকালীন দমদম এয়ারপোর্ট অঞ্চলের আশেপাশে একটি বড় এলাকায় ছিল বাঙালি মুসলমানদের বসবাস। বিধানচন্দ্র রায় এই বিরাট এলাকা থেকেও মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে চেষ্টা করেন। নিজের এই মনোভাবের সমর্থনে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে একটি চিঠিও লেখেন। জওহরলাল নেহরু অবশ্য বিধানচন্দ্র রায়কে এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেন। বিধানচন্দ্র রায় ও জওহরলাল নেহরুর মধ্যে যে পত্র বিনিময় হয়– তা সরকারি প্রকাশনা ‘সিএম টু পিএম’ নামক তথ্যগ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও বলব– বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন এক বিরাট ব্যক্তিত্ব। এই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের জন্ম ও মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।