রামিজ রাজা
৫ অক্টোবর নিঃশব্দে পার হয়ে গেল ইতিহাসের পাতায় ভুলিয়ে দেওয়া দুইজন মহান বঙ্গসন্তান আবুল হাশিম ও যোগেন মণ্ডলের প্রয়াণবার্ষিকী। তাঁরা সমসাময়িক ছিলেন এবং বাংলা বিভাগ পূর্ববর্তী সময়ে বাংলার রাজনীতিতে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বাংলার এই দুই মহৎ সন্তান ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। যোগেন মণ্ডল ও আবুল হাশিম মৃত্যুবরণ করেন যথাক্রমে ১৯৬৮ এবং ১৯৭৪ সালে। বর্তমান বাঙালি মননে এই দুইজনই বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। এমনকি স্বীয় ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীও মনে রাখেনি এই দুই মহাত্মাকে।
আপোষহীন– জ্ঞানী ও বিচক্ষণ আবুল হাশিম ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। আবুল হাশিম খুব দৃঢ়ভাবে ১৯৪৬ সালে জিন্নাহর পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে আবুল হাশিম মুসলিম লীগের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত না হয়ে যুক্ত বাংলার দাবি তোলেন এবং শরৎ বসুর সঙ্গে একটা প্যাক্ট তৈরি করেন যা বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি নামে ইতিহাসে সুপরিচিত হয়ে আছে। এই চুক্তি ছিল বাংলাকে অখণ্ড রাখার সর্বশেষ প্রচেষ্টা। বলা বাহুল্য– তৎকালীন বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই চুক্তি নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখাননি। আবুল হাশিম নিজস্ব নীতিতে অটল থেকে সবশেষে ব্যর্থ হন। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির জয় হয়। ১৯৪৭ সালের ১০ মে আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সোদপুর আশ্রমে দেখা করেন। সেখানে আবুল হাশিম গান্ধীজির নিকট সাধারণ ভাষা– সাধারণ সংস্কৃতি এবং সাধারণ ইতিহাস যা হিন্দু মুসলমান উভয়কে একসূত্রে আবদ্ধ করেছিল– তার উপর ভিত্তি করে ‘যুক্ত বাংলার’ উপর তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। গান্ধীজি রাজি হলেও কংগ্রেস হাইকমান্ড বাংলাকে অখণ্ড রাখার এই দাবি মেনে নেয়নি। তৎকালীন কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সরদার বল্লভভাই প্যাটেল বসুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন– শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন– কলকাতা আমাদের চাই। মূলত বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবের বিপরীতে বাংলার বিভক্তি হওয়াতেই রাজনীতি থেকে ব্রাত্য হয়ে পড়েন আবুল হাশিম।
অচ্ছুত ‘তফসিলি হিন্দু’ এবং ‘অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণি’র সঙ্গে ‘ম্লেচ্ছ’ মুসলমানদের ঐক্যের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ‘বহুজন’বাদী রাজনীতি গড়ে তোলার প্রধান কারিগর ছিলেন মহাপ্রাণ যোগেন মণ্ডল।১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় বিধানসভায় তপশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করে তিনি ‘ইনডিপেনডেন্ট শিডিউলড কাস্ট পার্টি’ নামে একটি নিরপেক্ষ তফশিলি দল গঠন করেন। এহেন বহুজন দরদী মহাপ্রাণ যোগেন মণ্ডলকেও মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে নি বর্তমান বাঙালি জাতি। অপরপক্ষে স্বীয় ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের একটা অংশ যোগেন মণ্ডলের নামে কু-মন্তব্য করতেও পিছপা হয় না। এরুপ আচরণের পিছনে মূল কারণ বাংলা বিভাগ পরবর্তী সময়ে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের যোগেন মণ্ডলের যোগদান। তিনি পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। পাকিস্তানি প্রশাসনের হিন্দু বিরোধী পক্ষপাতিত্ব অনুধাবন করার কথা উদ্ধৃত করে ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ভারতে ফিরে আসেন। বৃহৎ সংখ্যার হিন্দু পাকিস্তানে অত্যাচারিত হয়ে উদ্বাস্তু হবার জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের একটা অংশ যোগেন মণ্ডলকে দায়ী করে থাকে। তিনি একাকিত্বের মধ্যে নিজের শেষ জীবন একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসনে অতিবাহিত করেন।
ইতিহাসবেত্তারা এখন অবধি শুধু মুসলমানদের হিন্দু বিরোধী পক্ষপাতিত্বের কারণেই যোগেন মণ্ডলের পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে ফিরে আসার কথা বলেন। কখনো বলা হয় না পক্ষপাতিত্ব করা মুসলমানরা বাঙালি মুসলমান ছিল না। ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি হত্যা হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদারদের কুখ্যাত অপারেশন সার্চলাইটের দুর্বিষহ ইতিহাস আজও তাজা বাঙালি মননে। অনেক ক্ষেত্রে এই পাকিস্তানি মুসলমানরা বাঙালি মুসলমানদের আর্থসামাজিক– সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছিল। সেখানে যোগান মণ্ডলের নিজের সম্প্রদায়ের জন্য পাকিস্তানি মুসলমানদের কাছে করা দাবিদাওয়া পাকিস্তানিদের পক্ষে মেনে না নেওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি?
বর্তমানে বাঙালি জাতি ধর্মীয়– রাষ্ট্রীয়– ভৌগোলিক পরিচয়ে বিভাজিত। বিভাজিত এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর উপর অত্যাচার করতে পিছপা হয় না। এপার থেকে ওপারে– ওপার থেকে এপারে বাঙালি উদ্বাস্তু হয়। বাঙালি অত্যাচারিত হয়– নিজের সাংস্কৃতিক পরিচিতি হারায়। নিজের জাতি পরিচয় দিতে কুন্ঠাবোধ করে। উগ্রতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে হারাতে বসেছে হাজার বছর ধরে অর্জন করা বাঙালিত্ব। অহরহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় প্রাণ হারাচ্ছে বাঙালি। যোগেন মণ্ডল ও আবুল হাশিম দুজনেই নীতিবান ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। বাংলা ভাগ হলে বাঙালি জাতি যে দুর্গতির কবলে পড়বে একথা তাঁরা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা কখনো বাংলা ভাগ চান নি। তৎকালীন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপক্ষে গিয়েছিলেন বলেই আজকে তাঁদের নাম ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের জন্মবার্ষিকী বা প্রয়াণ বার্ষিকীতে সরকারি অনুষ্ঠান হয় না। বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ওঁদের অখণ্ড বাঙালিত্ব চেতনা চর্চা করার প্রয়োজন বোধ করে না। আজ বাঙালি জাতির এই দুর্দিনে একজন যোগেন মণ্ডল বা একজন আবুল হাশিমের খুব প্রয়োজন। হাশিম– যোগেনরা বারবার ফিরে আসুন বাংলার মাটিতে। ধন্য হোক বাংলার মাটি। বাঙালি আবার ঐক্যবদ্ধ হোক। জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করুক।
তথ্যসূত্র
১. বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি– বদরুদ্দীন উমর
২. রেজিগনেশন লেটার– যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল (৮ অক্টোবর– ১৯৫০)