শিক্ষার পথ ধরে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার দিশা যেমন দেখিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তেমনই বাংলার মুসলিম মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার সেই পথ দেখিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে জগৎটাকে চেনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাদের এই মহীয়সী নারী। আজ তাঁর একইসঙ্গে জন্ম ও মৃত্যুদিনে সেই অবদানের কথা লিখেছেন ড. কুমারেশ চক্রবর্তী
নিশুতি রাত। চারধার অন্ধকার। বাগানঘেরা বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়িটা নিস্তব্ধ প্রাণহীন অবস্থায় রয়েছে। ঠিক সেই মাঝরাতে ঘর থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল ছোট্ট একটি মেয়ে, সন্ত্রস্ত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বারান্দা দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। নির্দিষ্ট ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। আলতো ভাবে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। দেখা গেল ঘরের মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছে একটি পুরুষ। ঘরে ঢুকেই মেয়েটি দরজা বন্ধ করে দিল। এই শিশুকন্যাটি হচ্ছে ভবিষ্যতের নারী মুক্তি আন্দোলনের দিশারী বেগম রোকেয়া, আর মোমবাতি জ্বেলে বসে আছে তারই দাদা ইব্রাহিম। হ্যাঁ, এই ভাবেই রোকেয়া লুকিয়ে লুকিয়ে দাদার কাছে গভীর রাতে এসে ধীরে ধীরে শিখছিল বাংলা এবং ইংরেজি। কারণ তার বাড়িতে মেয়েদের শিক্ষা অন্যায় বলে মনে করা হত। তাই রোকেয়া গভীর রাতে দাদার কাছে এসে বাংলা এবং ইংরেজি শিখত। শুধু সে একা নয়, অনেক সময় থাকত তার দিদি করিমুন্নিসা। এই দিদির কাছেই রকেয়া মাটিতে আঁচড় কেটে বাংলা অক্ষর শিখেছিল। রোকেয়া নিজেই লিখেছেন, তিনি (দিদি) আমাকে দু’হরফ বাংলা পড়াইবার জন্য সমাজের বহু নিন্দা এবং ভ্রূকুটি সহিয়াছেন।
এই ছিল আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের প্রকৃত চিত্র। অবশ্য শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু সমাজের অবস্থাও ছিল প্রায় একই রকম। রোকেয়া তাই তাঁর নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন নারী সমাজের করুণ অবস্থার কথা এবং তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন শিক্ষা ছাড়া মেয়েদের মুক্তির উপায় নেই। তাই নিজে যেমন অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে লেখাপড়া শিখেছেন, অন্যের শিক্ষা লাভের জন্য সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষার প্রসার ঘটলেই কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দূর হবে এবং বিশেষ করে নারী জাতি স্বাধীনভাবে একটু নিঃশ্বাস নিতে পারবে। তাই তিনি একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং সামাজিক সংগঠন তৈরি করে নারী মুক্তির দিশারী হয়ে উঠেছিলেন।
১৮৯৮ সালে ভাগলপুরে অত্যন্ত শিক্ষিত সংস্কৃতিমনস্ক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিবাহ হয়। কথায় বলে, একজন সফল পুরুষের পেছনে সর্বদাই কোনও না কোনও নারীর অবদান থাকে। কিন্তু একটি নারীর প্রতিষ্ঠার পেছনে যে পুরুষের অবদান অত্যন্ত প্রয়োজন, তার আদর্শ নিদর্শন রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। বেগম রোকেয়ার মনের সব ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনি সব রকমের সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছেন। সাহিত্য চর্চা, শিক্ষার প্রসার, দারিদ্র দূরীকরণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সব ব্যাপারেই রোকেয়ার পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী। তাই ১৯০৯ সালের ৩ মে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ওই সালেই ১৩ অক্টোবর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠার সাহস পেয়েছিলেন। মাত্র পাঁচজন মেয়েকে নিয়ে এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে রোকেয়ার অক্লান্ত পরিশ্রমে ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল আশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পারিবারিক কারণে ১৯১১ সালেই তাঁকে কলকাতায় চলে আসতে হল। কলকাতায় এসে তিনি মেয়েদের জন্য একটি উপযুক্ত আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে নাম দিলেন শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। যা আজও নারী শিক্ষায় একটি গর্বের বিষয় হয়ে রয়েছে।
আজ থেকে শতাধিক বছর আগে এই কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ-সরল ছিল না। প্রবল বাধা-বিপত্তি, নিন্দা-অপবাদ সহ্য করে রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রসারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্কুল তৈরি হলেও ছাত্রী আনা যে কত কঠিন তিনি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। তবে অভিভাবকদের অনেক বুঝিয়ে মেয়েদের স্কুলে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। সামাজিক বাধাকে তিনি একেবারে অস্বীকার করতে পারেননি, তাই মেয়েদের স্কুলে আসা যাওয়ার জন্য যে বাস ঠিক করেছিলেন তার সমস্ত জানলা দরজা খড়খড়ি দিয়ে বন্ধ করা থাকত। কোনও আলো বাতাস ভেতরে ঢুকত না। এর ফলে মাঝে মধ্যেই দু-একজন ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ত। তাই কাপড়ের পর্দার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু এতেও এল প্রবল বাধা। কিছু মানুষ এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠে তাঁকে হুমকি দিলেন, বাতাসে পর্দা সরে গেলে মেয়েদের হাত দেখা যাচ্ছে, এরকম চলতে থাকলে আমরা তোমার স্কুল তুলে দেব। ইতিহাস বলে, এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে সব পথপ্রদর্শককে এই একই পরিস্থিতি মুখে পড়তে হয়েছিল। আর এক কিংবদন্তি সমাজ সংস্কারক, নারী শিক্ষার প্রসারে পথিকৃৎ বিদ্যাসাগরকেও অনেক হেনস্থা, অপবাদ, নিন্দা সহ্য করতে হয়েছিল।
বেগম রোকেয়া বুঝেছিলেন, মুসলিম নারী সমাজের ওপর কুসংস্কার এবং নিরক্ষরতার যে জগদ্দল পাথর চেপে বসে আছে তা সরাতে হলে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নয়, দরকার সামাজিক আন্দোলন। তাই তিনি গড়ে তুললেন একটি সংগঠন। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ বাংলায় যাকে বলা যায় মুসলিম মহিলা সমিতি। এর মাধ্যমে তাঁরা মুসলিম নারীদের সচেতন করে তুলতে লাগলেন, একই সঙ্গে তাদের শিক্ষা, কর্ম, সব কিছু দিয়ে স্বনির্ভর করে তুলতে সচেষ্ট হলেন। গড়ে তুললেন নারী মুক্তির আন্দোলন। শুধু মুসলিম নারী মুক্তি নয়, এর সঙ্গে শামিল করলেন হিন্দু মহিলাদেরও, গড়ে তুললেন নানা কেন্দ্র যাতে সমস্ত মেয়েরাই হয় স্বনির্ভর। একইসঙ্গে এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি দরিদ্রদের খাদ্য বিতরণ করা, নিরক্ষরকে সাক্ষর করা, দরিদ্র মেয়েদের বিবাহের ব্যবস্থা করা এবং ছোটখাটো কাজ দিয়ে তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে প্রায়সী হলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম এবং তাঁর ব্যবহার দিয়ে সেই সময়কার পর্দানশীন সমাজের এক অংশের সমর্থন পেলেন, এগিয়ে এল বহু হিন্দু-মুসলিম নারী এবং পুরুষ।
বেগম রোকেয়া ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, শুধু শিক্ষা অনুরাগী নয়। তিনি ছিলেন একজন সফল সাহিত্যিক। প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস সবেতেই ছিল তাঁর সাবলীল বিচরণ। বক্তা হিসেবে তাঁর তুলনা মেলা ভার। যেমন সংগঠক, তেমনই পরিচালক। বেগম রোকেয়া আজকের সমাজে একজন আদর্শ নারী। বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাতেই বেগম রোকেয়া ছিলেন সমান পারদর্শী। আর তাঁর এই লেখায় প্রধান প্রেরণাদাতা ছিলেন স্বামী সাখাওয়াত হোসেন।
১৯০৫ সালে ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সেই বিখ্যাত ইংরাজি লেখা ‘সুলতানা’স ড্রিম’, যা তাঁর স্বামীর প্রচেষ্টায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে। এটি ছিল একটি ক্ল্যাসিক উপন্যাসের মতো, যেখানে তিনি একটি কল্পিত নারী দেশের কথা বলেছেন যেখানে পুরুষরা আছে গৃহবন্দী হয়ে, পর্দাশীন হয়ে। আর নারী বাইরে সব কাজ করে, শাসন করে।
নারী হয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে এ ছিল কঠোর কষাঘাত। পরে এটি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে বঙ্গানুবাদ হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০৫ সালে তাঁর প্রবন্ধ সংকলন মতিচুর প্রকাশিত হল। তারপর সাত, আট, নয় সাল পর্যন্ত তিনি প্রচুর লিখলেন। কিন্তু ১৯০৯ সালে স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের অকালমৃত্যু তাঁর লেখনিকে স্তব্ধ করে দিল। বেশ কয়েক বছর পরে আবার তিনি শুরু করলেন, প্রায় ১৯১৫ সাল থেকে।
নারীর উপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তাঁর কর্মযোগী ভূমিকার মতো তাঁর লেখাতেও ছিল এর প্রতিফলন। নারীর ভেতরের সত্তাকে জাগিয়ে তোলা, তাদের স্বাধীন কর্মভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা, তাদের চিন্তার আকাশকে বৃদ্ধি করাই ছিল তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। রোকেয়ার প্রতিটি লেখাই যুক্তিনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানমনস্ক। অত্যন্ত সহজ ভাবে লেখা তাঁর ব্যঙ্গাত্মক লেখাগুলি মানুষের মনকে নাড়িয়ে দিত। যথার্থ অর্থেই বেগম রোকেয়ার লেখনি ছিল তরবারির চেয়েও ধারালো।
সেই সময় বাড়ির মেয়ে-বউরা এমন পর্দানশীন থাকতেন যে পুরুষ তো দূরের কথা, বাইরের মহিলারা এলেও তারা সামনে থাকতেন না। বাইরের মহিলারা বাড়িতে ঢুকলেই তারা গিয়ে দরজা বন্ধ করত। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘কেউ বাঘ ভাল্লুকের ভয়েও বোধহয় এমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না।’ মতিচুরের মতো উপন্যাসধর্মী লেখা তিনি অনেক লিখেছেন, তবে তাঁর একমাত্র উপন্যাস ছিল ‘পদ্মরাগ’। যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
বেগম রোকেয়া কিন্তু বাংলায় তষার যথাযোগ্য সম্মান পাননি। তাঁর স্বপ্ন ছিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা। কিন্তু অর্থের অভাবে এবং তাঁর অকাল প্রয়াণে এই স্বপ্ন সফল হয়নি। সেই স্বপ্ন সফল করতে বেগম রোকেয়ার নামে একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক