সুমনা সাদাকাতঃ রাজনীতি, বাণিজ্য ও বিদ্যাচর্চার পর বিনোদন জগতও কদর্যতা ও অবমাননায় ভরিয়ে দিচ্ছে মুসলিমদের। বলিউড ব্লকবাস্টারগুলি মুসলিমদের যথার্থ ভাবে চিত্রিত করতে ব্যর্থ। চলচ্চিত্রের অধিকাংশ চিত্রনাট্য থেকেই মুসলিমরা হঠাৎ বাদ পড়ে গিয়েছে। তবে, এই প্রতিনিধিত্বের অভাব ঢাকা পড়ে গেছে ইসলামোফোবিয়ার প্রতি বলিউডের সূক্ষ্ম রোমান্টিকতার আবহে। বছরের পর বছর ধরে এমন সব ছবি তৈরি হচ্ছে যেখানে মুসলিমদের দেখানো হচ্ছে খলনায়ক, হিংস্র, বর্বর, অত্যাচারী, কর্কশ, অসভ্য হিসেবে। এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে যেমন, পদ্মাবত, লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরকা, তানহাজি, কাশ্মীর ফাইলস প্রভৃতি।
প্রখ্যাত লেখক রবার্ট ম্যাককির মতে, ‘‘বিশ্বের কাছে কোনও ধারণাকে তুলে ধরতে গল্পকথন একটা শক্তিশালী মাধ্যম।’’ আর এই শক্তিকেই হিন্দি সিনেমা ব্যবহার করে যাচ্ছে, বরং বলা যায়, অপব্যবহার করে চলেছে। ভারতের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী বিনোদন শিল্প তার দর্শকদের ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে ভুল তথ্য জুগিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। ২০২২ সালটা একটা মাইলফলক হয়ে রয়েছে কারণ এই বছরই মুক্তি পায় ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো কুৎসিত ইসলামোফোবিক বিষয়। সাম্প্রদায়িকতার পথে সংখ্যাগুরু দর্শকদের তোষণ করতে বিভাজনমূলক রাজনীতি প্রচার করেছে এই ছায়াছবি। অন্যদিকে, ব্রহ্মাস্ত্র সিনেমাটি জাঁকজমক করে হিন্দু দর্শনকে চিত্রায়িত করেছে।
২০২৩ সালে একটি সিনেমা মুক্তি পেতে চলেছে। এর নাম ‘দ্য কেরল স্টোরি’। এই ছবির ট্রেলারই ইতিমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আঞ্চলিক ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরির চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দ্য কেরল স্টোরির অভিনেত্রীর পোস্ট করা ট্রেলারে দেখা যাচ্ছে, শালিনী নামের বুরকা পরিহিতা এক কেরল রমণী বলছেন, ইসলাম ধর্ম কবুল করতে কীভাবে তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়েছে, তাঁর নাম বদলে রাখা হয়েছে ফাতিমা বা এবং তাঁর মতো ৩২ হাজার মহিলার সঙ্গে জঙ্গি হিসেবে তাঁকে ব্যবহার করছে আইএসআইএস। এক মিনিটের বেশি এই ট্রেলারে প্রচার করা হচ্ছে, মুসলিমরা সন্ত্রাসী।
এটি যে মুসলিম-বিরোধী এক প্রোপাগাণ্ডা মুভি তা এই ছোট ট্রেলার থেকেই স্পষ্ট। এখন প্রশ্ন হল, ইসলামোফোবিক কন্টেন্টের এত রমরমা কেন ভারতে? এর উত্তর খুবই সহজ। ইসলামাতঙ্ক ছড়ালে প্রচুর ব্যবসা হয় আজকাল। প্রযোজকদের কোষাগার ভরে ওঠে নগদ মুনাফায়। বিনোদন শিল্প চলে মানুষের চাহিদা ও আগ্রহের উপর নির্ভর করে এবং তারা এমন বিষয়কে অবলম্বন করে সিনেমা নির্মাণ করে যা জন-অভিরুচিকে তুষ্ট করে এবং মানুষ উপভোগ করতে ভালবাসে। বর্তমান পরিস্থতিতে হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা হল সবচেয়ে লাভজনক উপাদান এবং বৈরিতাই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, মিডিয়া সংস্থা বিপুল আকারে এগুলিই খরিদ করে এবং মানুষকেই খাওয়ায়।
সাধারণ জনগণও স্বেচ্ছায় এই খাদ্য গ্রহণে একেবারে পিছিয়ে নেই। বিনোদন শিল্প ভেবেও দেখে না, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই প্রজ্জ্বলিত আগুনে কতখানি জ্বালানি যোগাতে পারে, এই সব কন্টেন্ট কতটা অস্থিরতা ও হিংসা ছড়িয়ে দিতে পারে। এই ধরনের ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রোপাগাণ্ডা রুখতে সেনশর বোর্ড বা কোনও কর্তৃপক্ষ মনে হয় ইচ্ছুক নয়। এর ফলে, এই ধরনের সংস্থার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হচ্ছে।
আরও দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হল, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী, প্রগতিশীল ও সচেতন বিনোদন শিল্পজগতই রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নিজেদের সুবিধা মতো অবহেলা করে, উদাসীন থাকে। বলিউডে চিরকালই মুসলিমদের আশীর্বাদ ও অবদান রয়েছে। ক্যামেরার সামনে হোক, বাইরে। ফলত, হিন্দি সিনেমার একটা দায় থেকেই যায়, যে-পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই বিগড়ে গেছে, তাকে আরও জটিল ও বিপজ্জনক করে না তোলা। তালাক-এ-হাসান নিয়ে বিতর্ক, ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে ভারতীয় মুসলিম মহিলারা শিক্ষার প্রাথমিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করছেন যখন, সেই রকম সময়ে এই ধরনের সিনেমা তাদেরকে আরও বদ্ধধারণা ও স্টিরিয়োটাইপের শিকার করে তুলবে।
ভারতের বাস্তবতায় একজন মুসলিম মহিলার আত্মপরিচয় বহন করে চলা কঠিন। নানা জায়গায় তাদের ছোট করে দেখার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে এবং মুক্তভাবে তাদের ধর্ম পালনের উপর খড়্গ নেমে আসবে। পাশাপাশি এই ছায়াছবিগুলি মুসলিম পুরুষদেরও সমান ভাবে মর্যাদাকে হানি করছে। তাদেরকে দেখানো হচ্ছে মৌলবাদী ও দানব হিসেবে, যারা মেয়েদের জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করায় এবং তাদেরকে যৌন উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মের নামে। নির্দিষ্ট ভাবে বললে, কেরলের মুসলিমরা দেশের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রাগ্রসর। সেই কারণে, কোনও তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই সংবেদশীল গল্পের মাধ্যমে তাদের মর্যাদাকে খাটো করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও, চলচ্চিত্র নির্মাতা একে সত্য হিসেবে উপস্থাপন করতে তৎপর। কিন্তু এমন কোনও সরকারি নথি নেই যা প্রমাণ করে টিজারে বর্ণিত এই ভেজাল দাবিকে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তিকে সম্পূর্ণ ভাবে কলুষিত করে এই ছবির নির্মাতারা এখন বাকস্বাধীনতার দাবি তুলেছেন। এমনকি তাঁরা লাভ জিহাদ ও ঘর ওয়াপসির আগুন জ্বালিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। বহু ডানপন্থী এই ছবির জন্য গলা ফাটাচ্ছে। তারা ভুলে গিয়েছে, এর ফলে আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যে উন্নতি হয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং উপমহাদেশের ভূ-রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকার উপর অনভিপ্রেত প্রভাব পড়তে পারে। এই ছবির ট্রেলার বৈদ্যুতিন মিডিয়ার গরম ও মুচমুচে টপিক হয়ে উঠেছে। অনেকেই ধারণা করছেন, কেরলের বামপন্থী সরকার ও মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করতেই একে হাতিয়ার করা হচ্ছে। এই মিডিয়াই এক সময়ে হিজাব, আজান, সম্প্রতি শ্রদ্ধা হত্যা নিয়ে মুসলিমদের লাগাতার অপমান করেছে ও করছে।
শ্রদ্ধার হত্যাকারী আফতাব আমিন পুনাওয়ালাকে নিয়ে মিথ্যাভাবে প্রচার করা হয়েছিল। যাইহোক, অধিকাংশের মত এই ধরনের ছায়াছবিগুলিকে মদত দিচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার। মিডিয়া ও ঘৃণাবাজরা শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছে, এই শত্রুতা ও ঘৃণার শিকড় কতখানি গভীরে এবং এটাই এখন স্বাধীন ভারতে ‘নয়া স্বাভাবিকতা’। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও একটি জাতি হিসেবে আমরা কত ভাগে বিভক্ত, সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই ছবি। এর ফলশ্রুতিতে, দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অ-সম্প্রীতি ও সহিংসতার দিকেও চলে যায়। যাইহোক, এই সিনেমার মুক্তি পেতে এখনও দেরি আছে। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়ার পর প্রেক্ষাগৃহে কতটা চলবে বা মানুষ কতটা একে গ্রহণ করবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে, সমস্ত বিতর্কের মধ্যেও এই ছবির ট্রেলারকে যেভাবে একটি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হচ্ছে তা হৃদয়বিদারক। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর কীভাবে গৃহীত হবে এ যেন তারই এক পূর্ব-ঘোষণা।