সাহানারা খাতুন:
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।” —-কাজী নজরুল ইসলাম
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। মুসলিম নারী সমাজে আলো জ্বালাতে প্রথম প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন নিজেই। তাঁর পিতার নাম জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের। মাতার নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। তাঁর দুই বোনের নাম করিমুন্নেসা ও হুমায়রা। তাঁর দুই ভাই ছিলেন মোঃ ইব্রাহিম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের।
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ছিল খুবই রক্ষণশীল। সেই প্রাতিষ্ঠানিকতার বেড়াজাল ভেঙে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দেন বেগম রোকেয়া। রোকেয়া খাতুন থেকে বেগম রোকেয়ার পথটা তৈরি হয়েছিল তার অক্লান্ত শ্রম একাগ্রতা ধৈর্য ও আধুনিক ভাবনার মাধ্যমে । যিনি আজও প্রতি মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক। নবজাগরণ বলতে আমরা সমাজের নতুন ভাবনার অগ্রগতিকেই মনে করি। এই চিন্তাধারায় যে নামগুলো আমাদের মনে পড়ে তাঁরা হলেন রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর প্রমুখেরা। সেই পথের পথিক হয়ে মুসলিম সমাজের নারীদের পথ দেখাতে বেগম রোকেয়া নিজের জীবনকে ব্রতী করেছিলেন। দৃঢ় নেতৃত্ব ও নিঁখুত পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর সাথে থাকা নারীদের শিক্ষাপ্রীতিতে প্রভাবিত করতেন বেগম রোকেয়া৷
আরও পড়ুন: গোলান মালভূমি দখলের চেষ্টা ইসরাইলের!
তাঁর নির্ভীক স্বভাব তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল লক্ষ্যের দিকে৷ ইচ্ছা করলে তিনি বাবার কাছে সচ্ছলতার সুখ ভোগ ও স্বামীর কাছে উন্নত জীবনযাপন করে সময় কাটাতে পারতেন, কিন্তু তাঁর সময়ে মুসলমান নারী সমাজের ভীষণরকম পিছিয়ে থাকার যন্ত্রণা তাকে নাড়া দেয়। ধর্মের গোঁড়া নিয়মে আটকে থাকা নারীর চাপা কান্না তাঁর হৃদয়কে মর্মাহত করে। তাঁর বিবেক তাঁকে পথে নামার অনুপ্রেরণা দেয়। তাঁর আধুনিক মনস্কতা তাঁকে সাহস জোগায়। বেগম রোকেয়ার মত এমন দৃঢ় চরিত্রের সমাজসেবী নারী আজও বিরল। তিনি যথেষ্ট উচ্চবংশীয় ছিলেন, কিন্তু আভিজাত্য নিয়ে কখনোই নিজেকে ভাসাতে চাননি তিনি। নারীর না পাওয়ার দিকগুলো তাঁকে মরিয়া করে তুলেছিল যার নাম নারীমুক্তি, নারী প্রগতি। তা-ই ছিল তার স্বপ্ন ও লক্ষ্য।
রোকেয়ার পরিবার সচেতন হলেও যখন তিনি বুঝতে পারলেন তাকে অন্যান্য মহিলাদের মত গৃহবন্দী থাকতে হবে এবং বিদ্যালয়ে যাওয়া হবে না তখন থেকেই তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। ছেলেবেলার রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁকেও বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তিনি বড় বোন করিমুন্নেসা ও বড় ভাই মোঃ ইব্রাহিমের কাছে অতি সন্তর্পণে পরিবারের চোখ এড়িয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিখেছিলেন। এই কাজে সহায়তা করার জন্য বড় ভাই ও বোন সমাজে অনেক ভর্ৎসনা সহ্য করতে হয়েছে এমনকি পরিবারের কাছেও।
আরও পড়ুন: গোলান মালভূমি দখলের চেষ্টা ইসরাইলের!
১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ বছরের রোকেয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। আধুনিক, উদারমনা সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বেগম রোকেয়ার জীবনে তাঁর স্বামী সাখাওয়াতের সাহচর্য ও পরামর্শ তাঁকে অনেক বেশি এগিয়ে যেতে ও সমাজে নারীদের জন্য কাজ করতে সাহায্য করে। সমালোচকরা মনে করেন,” সাখাওয়াতের সাথে বিবাহ রোকেয়াকে মুক্তি দেয় পৈতৃক পরিবারের সংকীর্ণ গন্ডি থেকে। তাঁর সব রকমের কাজের মূল কথা ছিল নারী জাগরণ ও মুক্তি।
তিনি বিশ্বাস করতেন মুসলিম সমাজ এখনও পিছিয়ে থাকার মূল কারণ নারীর অশিক্ষা ও অজ্ঞতা। একজন নারী অর্থাৎ মা যদি শিক্ষিত না হন কখনো সেই পরিবারের সন্তানের উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। পরিবারের ভাবনা, রুচি, সৃষ্টি সবই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন সন্তান তার মায়ের কাছে প্রথম শেখে। স্বামী সাখাওয়াত শুধু স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন না, সহধর্মিনী বেগম রোকেয়াকে অর্থ সাহায্য করেছেন নারী শিক্ষার কাজের জন্য। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ১৯০৯ সালে রোকেয়া স্বামীকে হারান । নারীর উন্নয়ন ও বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে তাকে যে কত বাধা বিঘ্ন সহ্য করতে হয়েছিল তা তাঁর ‘মতিচুর’ গ্রন্থে তিনি ব্যক্ত করেন করিমুন্নেসা উৎসর্গ পত্রে।
আরও পড়ুন: গোলান মালভূমি দখলের চেষ্টা ইসরাইলের!
গভীর রাতে অসীম আগ্রহে জ্ঞানপিপাসু রোকেয়া বড় দিদি ও দাদার কাছে বাংলা ও ইংরেজি পড়তে ও লিখতে শিখেছেন যা পরবর্তীতে ‘Sultana’s dream’ অর্থাৎ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লিখতে সাহায্য করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য ‘অবরোধবাসিনী’ তে তিনি নারীর পর্দা করার বিষয়ে নিজস্ব মতামত দিয়েছিলেন। নারীর পোশাক ও পর্দায় তিনি ঘোর বিরোধী কখনোই ছিলেন না৷ বেগম রোকেয়া সবসময় মাথায় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন । শরীর ঢেকে রাখতেন। ইসলামের এই বিধানকে তিনি শ্রদ্ধার সাথে পালন করতেন।
নারীকে অসম্মান করে তার স্বাধীনতা, শিক্ষা, জীবনচর্চাকে হরণকারী পুরুষ শাসিত সমাজকে তিনি নিন্দা করেছেন তাঁর একাধিক প্রবন্ধে । নারীর অধিকার জেনে বুঝে নেওয়ার আহ্বান জানাতেন। বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চা অদম্য সাহায্যের সাথে সামাজিক কাজ করা, নারী সমাজের উন্নতিকল্পে একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করা সমসাময়িক সবাইকে নাড়িয়ে দেয় তাঁর একক প্রচেষ্টায় । তিনি বলেছিলেন, “নারীরা জাগ্রত না হওয়া দেশবাসীর মুক্তি সম্ভব নয়।” তিনি আরো বলেন, “না জাগিলে ভারত ললনা, এ ভারত আর জাগিবেনা।”
তিনি ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সমিতি গড়ে তোলেন প্রায় একক প্রচেষ্টায়। নারী মুক্তি ও নারী শিক্ষাই ছিল তাঁর অন্বেষণ। স্বামীর মৃত্যুর দু’বছর পর ১৯১১ সালে কলকাতায় তিনি প্রথম স্বামীর নামাঙ্কিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল স্থাপন করেন। তখন থেকেই তিনি কলকাতায় পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই এটি ছিল এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। পরে এই বিদ্যালয়টি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় হয়েছিল। অবহেলিত পিছিয়ে থাকা মুসলমান সমাজের নারীদের জন্য তাঁর এই কাজকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী সরোজিনী নাইডু।
তিনি চিঠিতে লেখেন বেগম রোকেয়াকে এই বলে যে, “কয়েক বছর দেখছি আপনি কি দুঃসাহসিক কাজ করে চলেছেন। মুসলিম বালিকাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আপনি যে কাজ হাতে নিয়েছিলেন তার সাফল্যের জন্য দীর্ঘকাল যে ত্যাগ সাধন করে আসছেন তা বাস্তবিক বিস্ময়কর। আপনার প্রতি আমার আন্তরিক সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার উদ্দেশ্যে এই চিঠি লিখিলাম।”
বেগম রোকেয়া তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর বিদ্যালয়ের কথা চিন্তা করে গেছেন। তিনি প্রবল চেষ্টা করেও তাঁর বিদ্যালয়ে বাংলা শাখা খুলতে পারেননি। আত্মবিলাপে তিনি প্রকাশ করেই ফেলেছিলেন সে কথা ” কি লজ্জার বিষয়, এই কলকাতায় বাঙালি মুসলমান মেয়েদের জন্য এমন কোন বালিকা বিদ্যালয় নেই যাতে তারা বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করতে পারে,”
এই ছিল বেগম রোকেয়ার যন্ত্রণার কথা। তখনকার সামাজিক অবস্থার কথা আলোচনা করে তার বক্তৃতায় তিনি বিদ্রুপ করতেও ছাড়েননি, “বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়”। বেগম রোকেয়ার কর্মজীবন, সাহিত্য জীবন জুড়ে ছিল শুধুই নারী। আমৃত্যু তিনি ছিলেন নারী জাগরণের এক বিশিষ্ট সংগ্রামী। তাঁর ‘মতিচুর’ গ্রন্থে ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন,
“যাহা হউক, শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতির অন্ধ অনুকরণ নহে, ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়েছেন সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা”। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ তাঁর কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী শিক্ষার অভাবে এর কোন কিছুই সম্ভব নয় এই ছিল তাঁর আক্ষেপের বিষয়। বেগম রোকেয়া আসলেই এক প্রগতির নাম, উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি । এমন চিন্তাবিদ , প্রাবন্ধিক , সমাজ সংস্কারক আজও বিরল। আজও যিনি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। সব সমাজ জাতি সম্প্রদায়ের জন্য তিনি আদর্শ৷