বিশেষ প্রতিবেদক: অবশেষে পতন হয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের। দামেস্ক ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি। দামেস্কে ঢুকে পড়েছে বিদ্রোহীরা। গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় আক্রমণ চালিয়ে অনেকটা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, মাত্র ১২ দিনে, আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছে বিদ্রোহীরা। ১৯৭০ সাল থেকে দেশটির ক্ষমতায় ছিল আসাদ পরিবার। দুই যুগেও যা সম্ভব হয়নি, মাত্র ১২ দিনের অভিযানে সেই কাজ করে ফেলেছে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো ও হামা-র দখল নেয় বিদ্রোহীরা। এরপর দখল নেয় আর এক গুরুত্বপূর্ণ শহর হোমস-এর। অবশেষে রবিবার তারা দখল নিল দামেস্কের।
জর্ডান সীমান্তের কাছে দক্ষিণ সিরিয়ার দারা অঞ্চলের প্রায় পুরোটা স্থানীয় বিদ্রোহীদের দখলে চলে গিয়েছিল আরও আগেই। এই এলাকাটি ২০১১ সালের আসাদবিরোধী অভ্যুত্থানের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। আকস্মিক এই আক্রমণে সিরিয়ার সামরিক বাহিনী বলতে গেলে কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেনি। আসাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালনা করছে ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। সিরিয়ার দীর্ঘ সংঘাতময় ইতিহাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই গোষ্ঠী।
কারা এই হায়াত তাহরির আল-শাম?
এইচটিএস-এর যাত্রা শুরু হয় অন্য একটি নামে, ২০১১ সালে। আল-কায়েদার সরাসরি সহযোগী হিসেবে জাবহাত আল-নুসরা নামে যাত্রা শুরু করে গোষ্ঠীটি। ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস) নেতা আবু বকর আল-বাগদাদিও এই গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে ফ্রি সিরিয়া ব্যানারের আওতাধীন প্রধান বিদ্রোহী জোটের সঙ্গে মাঝে মাঝেই সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হত তাদের। ২০১৬ সালে গোষ্ঠীটির নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জাওলানি প্রকাশ্যে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর তিনি জাবহাত আল-নুসরাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে নতুন সংগঠন গঠন করেন। সংগঠনটির নাম দেন তাহরির আল-শাম। এক বছর পর এর সঙ্গে একীভূত হয় সমমনা আরও বেশ কিছু গোষ্ঠী।
বেশ কিছু সময় ধরেই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইদলিব প্রদেশে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে এইচটিএস। সেখানে কার্যত তারাই স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকায় রয়েছে। যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে প্রশাসক তাদের বৈধতা আটকে গিয়েছিল। এছাড়া আরও কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গেও অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে এইচটিএস-এর। আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর থেকে এইচটিএস শুধু সিরিয়ায় শাসন তাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছে। আইএসের মতো বৃহত্তর খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেনি তারা। গত এক যুগ সময়ের এই সংঘাতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ এখন শরণার্থী অথবা বিদেশে আশ্রয়প্রার্থী। আসাদ রাশিয়ার শক্তিশালী বিমান হামলা এবং ইরানের সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ইরান মূলত হিজবুল্লাহ-সহ তাদের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে এই সহায়তা দিত।
তবে সম্প্রতি ইসরাইল লেবাননে হামলা চালানোর পর হিজবুল্লাহ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি সিরিয়ায় ইরানি সামরিক কমান্ডারদের ওপর ইসরাইলের হামলা জিহাদি ও ইদলিবের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আলেপ্পোতে আকস্মিক আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে ভূমিকা রাখে। গত কয়েক মাস ধরে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলার ব্যাপকতা বাড়িয়েছে ইসরাইল। এ সব আক্রমণে তাদের সরবরাহ লাইন ও মিলিশিয়া কার্যক্রম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সিরিয়ায় সক্রিয় হিজবুল্লাহ-সহ অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আকস্মিকভাবে আলেপ্পোর দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এই পদক্ষেপ আসাদের বাহিনীকে একেবারে দুর্বল অবস্থায় ফেলে দেয়। তার জেরেই একের পর এক শহরের দখল নিয়ে আসাদের পতন ঘটাল এইচটিএস।