দামেস্ক: বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০০ সালে। এরপর পেরিয়ে গেছে ২৪ বছর। মাঝে দেশটির কবি-সাহিত্যিক- সংস্কৃতি কর্মীদের হাত ধরে এসেছে ‘দামেস্ক বসন্ত’। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। আমেরিকা, রাশিয়া পর্যন্ত হস্তক্ষেপ শুরু করে সিরিয়ায়। কিন্তু বাশার আল-আসাদ টিকে ছিলেন ক্ষমতায়। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে দামেস্ক ছেড়ে পালাতে হল আসাদকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন এক পালাবদল এনে দিতে পারে। সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্যেও বদল আসবে নিশ্চিতভাবেই। ইরান, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, লেবানন, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনীতি নতুন রূপ নেবে এর ফলে। বিশেষ করে এটি ইরানের জন্য হবে বড় ধরনের আঘাত। আল জাজিরার বিশেষ প্রতিবেদক জেইনা খোদর বলেন, আসাদ সরকারের পতন ইরানের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। কারণ গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নানা ধরনের রূপান্তর এসেছে। বিশেষ করে এই অঞ্চলে ইরানের ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং সেটি গোটা অঞ্চলেই।
জেইনা বলেন, ইরাক থেকে শুরু করে সিরিয়া এবং এমনকি লেবাননেও ইরানের প্রভাব ছিল বিস্তৃত। এ সব দেশের ক্ষমতায় যারা ছিল, সবার সঙ্গেই ইরান সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল ইরানের পক্ষে।
কেবল সিরিয়া নয়, লেবাননেও গত কয়েক বছরে ইরান তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ইরানই সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে; এমন তথ্য সর্বজনস্বীকৃত। ফিলিস্তিন ও লেবানন ছাড়িয়ে ইসরাইলের ইরানে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পেছনেও রয়েছে মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ।
আসাদের পতন এবং সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধাবস্থা ইরানের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন জেইনা। হিজবুল্লাহর পক্ষে এখন ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে গেছে। লেবাননে যুদ্ধবিরতি চললেও এর মূল বার্তাই হল হিজবুল্লাহকে অস্ত্র ছাড়তে হবে। আর হিজবুল্লাহ অস্ত্র ছেড়ে দুর্বল হয়ে পড়লে তার প্রভাব ইরানের ওপরও পড়বে।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী চাইছে হিজবুল্লাহ যেন আর সশস্ত্র না হয়ে উঠতে পারে। ইরানকেও যথাসম্ভব দমিয়ে রাখতে চায় ইসরাইল। এ কারণেই গত কিছুদিনে কেবল লেবানন নয়, সিরিয়াতেও ইসরাইলি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণ দেখা গেছে। কারণ ইসরাইলের ধারণা, সিরিয়ার ওইসব এলাকায় ইরানের সামরিক অবস্থান রয়েছে।
এ দিকে সিরিয়ার চলমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া-তুরস্কের নামও জড়িয়ে রয়েছে। সিরিয়ার বিoোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামসকে (এইচটিএস) সরাসরি সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক। এ বছরের শুরুতে সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল তুরস্ক। কিন্তু সিরিয়া থেকে তুরস্কের বাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত সিরিয়া কোনও আলোচনায় বসবে না বলে জানায়।
এর আগে ২০১৭ সাল থেকে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়ায় শান্তি ফেরানোর জন্য। তিন দেশের মধ্যে ওই সময় থেকে এখনও পর্যন্ত ২১টি বৈঠক হলেও অচলাবস্থা কাটেনি। সবশেষ সম্প্রতি কাতারের দোহায় তিন দেশের মধ্যে বৈঠকের পর দেশ তিনটির অবস্থান দাঁড়ায় এমন সিরিয়ায় বিoোহী, ইসলামপন্থী ও তুরস্কপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের উপস্থিতিতে তুরস্কের কোনও আপত্তি নেই। অন্যদিকে, তাহরির আল-শামসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করে আসছে ইরান ও রাশিয়া।
দোহার বৈঠকে ইরান বারবার চেষ্টা করেছে এটা বোঝানোর জন্য যে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের এভাবে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে আসাদ সরকারে পতন ঘটালে তা ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি করবে, যার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসীরা রাজত্ব কায়েম করবে। এ ক্ষেত্রে সুযোগ নেবে ইসরাইল, যারা মূলত সিরিয়ার সংঘাতকে অস্ত্র করে সিরিয়া থেকে লেবানন পর্যন্ত ইরানের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের রুটকে বন্ধ করে দিচ্ছে।
বিদ্রোহীদের হাত থেকে আসাদ সরকারকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সর্বোচ্চ দর কষাকষির চেষ্টা করেছে ইরান। আসাদের শাসনের অবসানের পর সিরিয়ায় কী ঘটবে, সেটি এখনই বলা মুশকিল। তবে তার পতন, বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখল মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে একটি বড় ধরনের পালাবদলের সূচনা। এটি ইরানের জন্যও নিঃসন্দেহে একটি বড় ধাক্কা। আর এতে দুর্বল হবে হিজবুল্লাহও। হামাস ও গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনেও এর প্রভাব পড়তে পারে!