কিবরিয়া আনসারী: সম্প্রতি সংবাদে এসেছে কাজান শহরের নাম। এই শহরেই এবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রিকস সম্মেলন। তিন দিনের এই সম্মেলনে যোগ দিতে শহরটিতে পা রেখছেন বিশ্বনেতারা। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। ব্রিকস সম্মেলনের কারণে কাজান নামটা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু কোথায় অবস্থিত এই কাজান শহর? এর ইতিহাসই বা কি রয়েছে?
পৃথিবী সভ্যতার উত্তোরণে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। সময়ের গভীর গহ্বরে হারিয়ে গেছে কত সভ্যতা! ধূলোয় মিশে গেছে কত স্থাপনা। পৃথিবীর ধূলোয় লেগে আছে সে সব ইতিহাস, যার অনেক কিছুই আমরা জানি না। খুঁজে পাইনি ধূলো ছাড়া। বর্তমান পৃথিবীর টিকে থাকা সভ্যতাগুলো প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করছে নতুন নতুন শহর। গ্রামগুলোও ধীরে ধীরে নিয়ে নিচ্ছে শহরের আদল। তারপরও প্রাচীন শহরগুলো কিন্তু এখনো তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য ঠিকই ধরে রেখেছে। ১০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন কাজান শহরটি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যে সমৃদ্ধ।
রাশিয়ান ফেডারেশনের একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ তাতারস্তান প্রজাতন্ত্র। তাতারস্তানের রাজধানীর নাম কাজান। এটাই তাতারস্তান প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। কাজান রাশিয়ার ৬ষ্ঠ সর্বাধিক জনবহুল শহর। কাজান ভোলগা নদী এবং কাজানকা নদীর সঙ্গমস্থলে রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ ৪৩ হাজার। তাতারস্তানের মানুষ রাশিয়ান ও তাতার ভাষায় কথা বলেন। সেখানে মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে রাশিয়ান রুবল।
Read More: মুঘল জমানার ১০ টি ঐতিহাসিক নিদর্শন
ঐতিহ্যবাহী স্বাদের খাবারে ভরপুর তাতার। রাশিয়ান, তুর্কি এবং মধ্য এশীয় খাবারের স্বাদ রয়েছে দেশটিতে। মাংসের পাই, ডাম্পলিংস, ভাজা ময়দা, চাক-চাক ও কাজানের সিগনেচার ডেজার্ট খাবারের সুনাম রয়েছে। এই শহরটি পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। দেশটির আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলি হল- কাজান ক্রেমলিন, অ্যানানসিয়েশন ক্যাথেড্রাল, সোয়েম্বিকা টাওয়ার, তাতারস্তান প্রজাতন্ত্রের জাতীয় জাদুঘর, অপেরা এবং ব্যালের কাজান স্টেট থিয়েটার, বাউম্যান স্ট্রিট (পথচারী শপিং স্ট্রিট) ও কাজান নদী বন্দর।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: তাতার এবং রাশিয়ার বহুমুখী সংস্কৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছে কাজানের সংস্কৃতি। ঐতিহ্যবাহী ‘কাজান ক্রেমলিন’ ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এছাড়াও বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং অত্যাশ্চর্য অ্যানানসিয়েশন ক্যাথেড্রাল এবং মহিমান্বিত সোয়েম্বিকা টাওয়ারের আবাসস্থল।
২০০৯ সালে কাজানকে রাশিয়ার “৩য় রাজধানী” মার্কাটি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়। একই বছর এটিকে রাশিয়ার “ক্রীড়া রাজধানী” উপাধি দেওয়া হয়। এবং আজও নগরটিকে এই উপাধি দিয়ে উল্লেখ করা হয়। ২০১৫ সালে ২১ লক্ষ পর্যটক বেড়াতে যায় শহরটিতে। কাজান নগরদুর্গ এবং শহরের হোটেল-বিনোদন ভবন ও স্থাপনাসংগ্রহ (যার ডাকনাম “কাজান তটভূমি”) পর্যটকদের প্রধান দুই আকর্ষণস্থল।
এখানকার নদী, শীতল ঝর্ণাপ্রবাহ, নয়নাভিরাম সবুজ দৃশ্য এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা যেন মনে দুর্দমনীয় ভালো লাগার ছবি এঁকে দেয়। কাজান শহর ও শহরের বাইরের পরিচ্ছন্ন সোজা রাস্তা, ভোরের আলো ফোটার আগেই পার্কগুলোতে ক্রীড়া উদ্যমী মানুষের ভিড় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। হেঁটে ভ্রমণ করার জন্য আদর্শ শহর কাজান। রাস্তায় কোনো যানবাহন না থাকলেও শহরের কেন্দ্র থেকে শহরের শেষ প্রান্তে হেঁটে মাত্র আধা ঘণ্টায়ই পৌঁছে যাওয়া যায়।
রাশিয়ার মুসলিমপ্রধান প্রদেশ তাতারস্তানের কাজান ক্রেমলিনের একটি আকর্ষণীয় মসজিদের নাম কোলশরিফ মসজিদ। এই মসজিদকে বিবেচনা করা হয় তাতারদের স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকগুলোর একটি হিসেবে। মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৬ শতকে, কাজান খাব রাজ্য যুগে। কাজান খানেইট ছিল একটি মুসলিম রাজ্য। ১৪৩৮ সালে রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য: ১৫৫২ সালে রাশিয়া এটি দখলে নেয়। এ সময় ভয়ঙ্কর ইভান মসজিদটি ধ্বংস করে। নির্মাণের সময় এই মসজিদ ছিল ইস্তাম্বুলের বাইরে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ। ধারণা করা হয়, এতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মিনার ছিল এবং এর গঠনে ছিল ছোট গম্বুজ ও তাঁবুর সমন্বয়। মসজিদটির নকশা করা হয়েছিল ভলগা বুলগেরিয়া স্থাপত্য রীতিতে, যদিও এতে প্রথম দিককার রেনেসাঁ ও ওসমানীয় (তুর্কি) স্থাপত্য ঘরানার প্রভাব ছিল। মসজিদের নামকরণ করা হয় কোলশরিফের নামানুসারে।
রাশিয়ার ইতিহাসে কাজান এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৫৫২ সালে ইভান দ্য টেরিবল শহরটি জয় করেন, যা রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সাথে তাতারস্তানের একীকরণের সূচনা করে। যদিও এইসব ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে তাতারস্তানের জাতীয় যাদুঘরে গেলেই এই শহরের অতীত অন্বেষণ করা যাবে।
কাজান শহরের ঐতিহাসিক তাৎপর্যের বাইরে বর্তমানে আধুনিক সংস্কৃতিতেও এগিয়ে যাচ্ছে। শহরটি নানান উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম কাজান আন্তর্জাতিক মুসলিম চলচ্চিত্র উৎসব, কাজান সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা এবং রঙিন সাবানতুই গ্রীষ্মের উৎসব।
এছাড়াও অসংখ্য উৎসবের আয়োজন করে কাজান। ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক গ্রীষ্মকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ২০১৪ সালের বিশ্ব অসিক্রীড়া শিরোপা প্রতিযোগিতা ও ২০১৫ সালের বিশ্ব জলক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছে দেশটি। এটি ২০১৭ ফিফা কনফেডারেশনস কাপের আয়োজক ছিল এবং ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার অন্যতম আয়োজক শহর ছিল। এই শহরটি তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক দৃশ্য নিয়ে গর্ব করে।
তাতারস্তানের রাজধানী কাজান একটি লুকানো রত্নের শহর, যা এখনও জনমানসে আসেনি। সমৃদ্ধ ইতিহাস, স্পন্দনশীল সংস্কৃতি এবং অত্যাশ্চর্য স্থাপত্য এই শহরটিকে একটি অবিস্মরণীয় করে তুলেছে। ইতিহাস প্রেমী বা নতুনত্বে আগ্রহী হন না কেন, কাজানে প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু রয়েছে।
1 Comment
Pingback: ইরানের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা ইসরায়েলের