ফিলিস্তিনে লাগাতার গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে শিশু, নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ অগণিত নিরীহ মানুষকে। সীমিতভাবে হলেও হামাস হার স্বীকার করেনি, তারা লড়ে চলেছে। বিশ্বজুড়ে মজলুম গাজাবাসীদের জন্য দোয়া হচ্ছে। কিন্তু গণহত্যার এক বছর পরও কেন মিলছে না আল্লাহর মদদ? কুরআন-হাদিসের আলোকে তার জবাব দিয়েছেন খ্যাতনামা এক ইসলামি স্কলার।
যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিন বহু অসহায় ও নিরাশ্রয় মানুষকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে বিতাড়িত অনেক মানুষের আশ্রয়স্থল ফিলিস্তিন। ইসরাইলের যেসব অধিবাসী আদি ফিলিস্তিনিদের অবৈধভাবে উচ্ছেদ করছে তারাও বিভিন্ন দেশ থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ফিলিস্তিনের পুণ্যভূমিতে।
ফিলিস্তিনকে বলা হয় নবী-রাসূলদের ভূমি। রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর সময়ে ফিলিস্তিন ছিল শামদেশের অন্তর্ভুক্ত। শামদেশ হল— বর্তমান সময়ের সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। নবীজি সা.-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ‘এই অঞ্চল হবে মুসলমানদের সেনাছাউনি। এখানে কিয়ামতের আগে হযরত ঈসা আ. আসমান থেকে অবতরণ করবেন। এই অঞ্চলেই দাজ্জালকে হত্যা করা হবে। এখানেই হবে কিয়ামতের ময়দান।’
উম্মতের মধ্যে একদল বিশেষ শ্রেণির লোক থাকবে, যাঁরা সত্যের পথে লড়াই করতে থাকবে। তাঁদের সঙ্গে আল্লাহ্র সাহায্য থাকবে। তাঁরা সত্যের পক্ষের সংগ্রামকে কিয়ামত না-আসা পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে। হাদিসের ভাষ্যমতে, ‘এই দলটি শামদেশ অঞ্চলের অবস্থানকারী হবে।’
হযরত মুগিরা ইবন শোবা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন, আমার উম্মতের এক দল সব সময় (সত্যের ওপর) বিজয়ী থাকবে। এভাবে কিয়ামত এসে যাবে আর তারা বিজয়ীই থাকবে।’ (বুখারী: ৭৩১১)
অথচ দীর্ঘ ১ বছর ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালাচ্ছে যায়নবাদী ইহুদি বাহিনী। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে শিশু, নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ অগণিত নিরীহ মানুষকে। রক্ত অশ্রুতে স্নান করছে ফিলিস্তিনবাসীরা। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে ইউরোপ-সর্বত্র ফিলিস্তিনিদের জন্য মানুষ হাত তুলে আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা করছেন। তাহলে আল্লাহ্তায়ালা ফিলিস্তিনকে কেন সাহায্য করছেন না?
এক অনুষ্ঠানে ওই ইসলামি পন্ডিতকে সঞ্চালক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, একাংশ যারা আল্লাহ্ ও তাঁর বিধান মানেন না, বা সব কিছুতে হতাশা ব্যক্ত করে তারা বলছেন, ফিলিস্তিনে এত মুসলিম শিশু, নারী, পুরুষ শহিদ হচ্ছেন। এত রক্ত ঝরছে তবুও আল্লাহ্ সাহায্য করছেন না কেন? আর বর্তমান জামানায় এখন বেশিরভাগ মুসলিম উম্মাহ্ হতাশায় ভুগছেন। এঁদের কি বলবেন? প্রশ্নের উত্তরে তিনি সূরা মুলকের ২ আয়াতের উদ্ধৃতি টেনে বলেন, আল্লাহ্পাক পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন— আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম?’ আল্লাহ (একদিকে যেমন) মহাশক্তিধর, (আবার অন্যদিকে) অতি ক্ষমাশীল। আর আমাদের উচিত, পবিত্র কুরআন ও হাদিস অনুসরণ করে জীবন অতিবাহিত করা।
আর ফিলিস্তনের বিষয়ে এই ইসলামি স্কলার বলেন, যাঁরা পবিত্র কুরআন ও হাদিস পড়েছে সেগুলোর তফসির করেছে তাঁরা বলবেন এটা আল্লাহ্তায়ালার ‘হিকমা’ অর্থাৎ আল্লাহর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞা। সূরা আলে ইমরান আয়াত ৫৪-তে আল্লাহ্ বলেন , ‘আর তারা কুটকৌশল করেছিল আল্লাহ্ও কৌশল করেছিলেন; আর আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।’ এবার অনেকে বলবেন, আল্লাহ্ চাইলেই তাদের সাহায্য করতে পারতেন, কেন করছেন না?
৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলের ওপর আক্রমণ শানিয়েছিল। তারপর ইসরাইল পাল্টা আক্রমণ করে। আল্লাহ্ চাইলে ১ মিনিটে ফিলিস্তিনকে বিজয়ী করে দিতে পারতেন। ওপরদিকে ইসরাইলকে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। কেন করলেন না? ওই স্কলার বলেন, ধরে নিন একদিনে আল্লাহ্তায়ালা ফিলিস্তিনকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিল। অনেকের প্রশ্ন, করল না কেন?
এই প্রথমবার জেনসাইডের লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। হিটলার, মুসোলিনি সাধারণ মানুষের ওপর যা অত্যাচার করেছিল সেগুলো এখন ছবি বা পুরানো ভিডিয়োর মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। তবে ইসরাইলের বর্বরতার খবর সমগ্র দুনিয়া দেখছে।
এতদিন মুসলিম ও ইসলাম সম্বন্ধে অমুসলিমদের ধারণা আলাদা ছিল। এতদিন মুসলিমরা হাদিসে নবী-রাসূল, সাহাবীদের ঈমানের কথা শুনেছে, তবে ফিলিস্তিনে ঘটনার পর মুসলিমদের ঈমানের দৃঢ়তার গল্প গোটা দুনিয়া জানছে।
ফিলিস্তিনের একটি ভিডিয়ো সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে ইহুদি হামলায় ছেলে শাহাদাত বরণ করেছে। আর তার আম্মাজান পুরো ঘটনায় আল্লাহ্র কাছে অভিযোগ না করে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছেন। তাঁকে বলতে শোনা গেছে, তুমি আরও ১০টি সন্তান দান করলেও তাদের আমি তোমার নামে কুরবান করে দেব। আলহামদুলিল্লাহ্।
পুরো হামলায় একটা বাচ্চার পা কাটা পড়ে। ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, গুরুতর আহত হওয়ার পর শিশুটি তার ক্র¨নরত আব্বাজানকে বলছে— ‘আব্বু তুমি কষ্ট পেয়ো না আল্লাহ্ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।’
অমুসলিমরা দেখছে কেমন ধর্ম এটা। কেমন দ্বীন এটা। এত সমস্যার পরেও, নিজের বাচ্চা শহিদ হওয়ার পরেও, পা চলে যাওয়ার পরেও আল্লাহ্র কাছে অভিযোগ করছেন না। বরং আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছে। সব কিছুতে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলছে। অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র। এই দৃশ্যের পরে হাজার হাজার অমুসলিমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ওই সময়ে শুধু ইউরোপে ৪০ হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিম দেশগুলোতে মুসলিমরাতো বিক্ষোভ করতই বর্তমান সময়ে পুরো বিশ্বে শুধু মুসলিম না অ-মুসলিমরাও ইসরাইলের বর্বরতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। ইসলাম ও আল্লাহর প্রতি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ইখলাস বা আন্তরিকতা দেখে মানুষের চিন্তা ধারা পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান সময়ে দুনিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে সওয়াল করছে। এক বছরে ফিলিস্তিনের মানুষরা সারা বিশ্বে ইসলামের যে নজিরবিহীন দাওয়াত দিচ্ছেন এক কথায় তা অকল্পনীয়। কোটি কোটি মানুষ ইসরাইল-বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। আল্লাহ্ একদিনে ফিলিস্তিনকে বিজয়ী ঘোষণা করলে এটা সম্ভব হ’ত না।
ওই ইসলামি স্কলার আরও বলেন, এক বছর আগের সময় ভিন্ন ছিল। তখন ৯০ শতাংশ অমুসলিমরা ইসরাইলের পক্ষে ছিল, এখন তারাই গাজার পক্ষে। আল্লাহ্র পরিকল্পনা সর্বোত্তম । যা একজন ব্যক্তির পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
যদি আল্লাহ্তায়ালা ফিলিস্তিনকে একদিনে বিজয়ী করতে চাইতেন, তবে তিনি তা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ, আল্লাহ্ একজন উত্তম পরিকল্পনাকারী। আল্লাহ্ যদি তাদের একদিনে বিজয়ী করতেন, তাহলে এক বছর ধরে চলা যুদ্ধে আজ হাজার হাজার মানুষ ফিলিস্তিনকে সমর্থন করত না। ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর ৯০ শতাংশ অমুসলিম ইসরাইলের পক্ষে ছিল, কিন্তু আজ ৯০ শতাংশ মানুষ বলছে যে গাজা সঠিকপথে রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে তিনি সূরা বাকারাহ্’র আয়াত নম্বার ২১৬-এর উদ্ধৃতি টেনে বলেন, ‘তোমাদের উপর লড়াইয়ের বিধান দেওয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ্ জানেন এবং তোমরা জানো না।’
সুতরাং একজন মুমিন কোনওদিন বলবে না আল্লাহ্ ভুল। মুমিন বলবে, আমি জানি না এই ঘটনার পিছনে আল্লাহর কি পরিকল্পনা রয়েছে, তবে এতটুকু জানি আল্লাহ্ যা করেন, ভালোই করেন। আর আল্লাহ্র প্রতিটি কাজের পিছনে কল্যাণ লুকিয়ে আছে।
আমারা সকলে এই পৃথিবীতে আছি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। আল্লাহ্ তো মানবকূলকে সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। গাজাবাসীও পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত। যারা ফিলিস্তিন-ইসরাইলের যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন তারা জান্নাতবাসী। আমাদেরও উচিত উত্তম মৃত্যুর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। আর একজন মুসলিমের কাছে এই দুনিয়া তো শেষ নয়। মৃত্যুর পরের দুনিয়াই সব। যেখানে তাদের অনন্তকালের জন্য থাকতে হবে।
1 Comment
Pingback: হাড়োয়াতে বামের ভরসা আইএসএফ, প্রার্থী আইনজীবী পিয়ারুল ইসলাম - PuberKalom.com