হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের শাহাদাতের মধ্য দিয়ে অবসান হল এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সাহসী লড়াইয়ের। দখলদার ইসরাইলিদের হাত থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তি ছিল তাঁর একমাত্র চাওয়া। তিনি অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থেকে যাবেন। হামাস তাই ঘোষণা দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতার লড়াই চলবে, আমরা হার মানব না। সিনওয়ারকে নিয়ে আজ বিশেষ প্রতিবেদন।
যুদ্ধের ময়দানে নিজে অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করা সেনাপতির সংখ্যা বিরল। মৃত্যুর সময় যিনি অস্ত্র ছাড়েননি সেই সেনাপতি এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তাব পাওয়ার পরেও প্রত্যাখ্যান করেছেন। সঙ্গীদের নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তেও গুলি ছুঁড়েছেন। সেই সিপাহ সালার বহু আগেই বলেছিলেন হাতে সময় কম, স্বাধীনতার সংগ্রাম তিনি উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। মাত্র ২৪ কিলোমিটার এলাকার ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে এক বছর ধরে বিশ্বের সেরা সেনাবাহিনী ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মারাত্মক সমরাস্ত্র এবং স্যাটেলাইট তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এই বীর সেনানী। এই বীর যোদ্ধার নাম ইয়াহিয়া সিনওয়ার। যার মৃত্যুর পরেও যুদ্ধ থেমে যাবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বৃহস্পতিবার রাতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস সংগঠনের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের শাহাদাতের খবর প্রদান করে যায়নবাদী ইহুদি বাহিনী।
দক্ষিণ গাজার রাফা শহরের একটি বিধ্বস্ত ভবনে ইসরাইলি ট্যাঙ্কের গোলায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে দাবি করেছে আইডিএফ।
লড়াইয়ের মাঝখানে হামাস প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেলেও সিনওয়ার গাজা উপত্যকাতেই ছিলেন। ইসরাইল তাঁকে গাজা ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও রাজি হননি এই যোদ্ধা।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের বরাত দিয়ে টাইমস অফ ইসরাইল জানিয়েছে, বুধবার দক্ষিণ গাজার রাফা শহরে সেনাদের হামলায় শহিদ হন হামাস প্রধান। তবে এটি তাঁকে লক্ষ্য করে কোনও বিশেষ অভিযান ছিল না।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানায়, একটি বিধ্বস্ত বাড়িতে কয়েকজন যোদ্ধার উপস্থিতি টের পেয়ে তারা সেখানে হামলা চালায়।
কয়েক দফা হামলা চালানোর পর বৃহস্পতিবার সকালে বাড়িটিতে প্রবেশ করে সেনারা। চেহারা দেখে তারা ধারণা করেন মৃতদের একজন হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার হতে পারে। এরপর লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ইসরাইল রেকর্ডের সঙ্গে মিলিয়ে তারা নিশ্চিত হয়।
তারপরেই সিনওয়ার নিহত হয়েছেন এ কথা সরকারিভাবে তারা ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা যুদ্ধে সিনওয়ারের রয়েছে অনন্য অবদান। ২৪ বছর ইসরাইলের কারাগারে থাকলেও তিনি একজন ইসরাইলি সেনার বদলে মুক্তি পান। হামাসের যুদ্ধ ক্ষমতা গড়ে তোলা ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অবদান অতুলনীয়। তিনি সব সময় শাহাদতের জন্য প্রস্তুত থাকতেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাস্থলে তিন যোদ্ধার চলাচলের ভিডিয়ো ধরা পড়ে। ইসরাইলি ড্রোনের ক্যামেরায় দেখা যায় সেটি। এরপর তাদের উপর হামলা চালায় ইসরাইলি যায়নবাদী সেনারা। মনে করা হচ্ছে, সঙ্গী দু’জন সিনওয়ারের দেহরক্ষী ছিলেন। তাঁরা সিনওয়ারকে নিরাপদ রাখতে চেষ্টা করছিলেন। হামলার পর তিনজনের মধ্যে দু’জন একটি বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেন। তৃতীয় ব্যক্তি অন্য একটি বিল্ডিং-এ প্রবেশ করেন। তাঁরা সবাই আহত ছিলেন বলে দাবি করে ইসরাইল। ইহুদি সেনা জানায়, দুই যোদ্ধার কাছ থেকে আলাদা হয়ে অন্য ভবনে প্রবেশ করা যোদ্ধাই ছিলেন সিনওয়ার। এরপর পাশাপাশি দুটো ভবনেই গোলা ছোড়ে ট্যাঙ্ক। এরপর সিনওয়ার দ্বিতীয় তলে উঠে যায়। পদাতিক সেনাদের একটি দল ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে সিনওয়ার দুটো গ্রেনেড ছোঁড়েন।
যার একটি বিস্ফোরিত হয় এবং সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তারা ওই ভবনে ড্রোন পাঠিয়ে যে ভিডিয়ো সংগ্রহ করেছে তাতে দেখা গেছে প্রায় বিধ্বস্ত একটি ভবনের সোফায় বসে আছেন আহত একজন। তাঁর মুখ ফিলিস্তিনি পতাকা/কেফায়া দিয়ে ঢাকা। ড্রোনটির উদ্দেশে তিনি একটি লাঠি ছুঁড়ে মারেন। ভিডিয়োতে তাঁকে জখম এবং জরাজীর্ণ মনে হচ্ছিল।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দাবি, ওই ব্যক্তি ছিলেন সিনওয়ার। এরপর আবারও গোলা ছোঁড়া হয়। এতেই তিনি শহীদ হন। পরদিন সকালে ভবন দুটিতে প্রবেশ করে ইসরাইলি সেনারা তিনটি লাশ দেখতে পান। চেহারা দেখে সন্দেহ হলে ইহুদি সেনারা তাঁর ডিএনএ নমুনা ও একটি আঙুল কেটে ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়। ইসরাইল সিনওয়ার তাদের হাতে বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর ডিএনএ সংগ্রহ করেছিল। টেস্টের পর মৃত যোদ্ধা সিনওয়ার বলে নিশ্চিত করে তারা। আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ওই ভবনে মৃত এক যোদ্ধার কাছ থেকে রাইফেল এবং কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। আমরা নিশ্চিত ওটা সিনওয়ার ছিলেন।
তাঁর কাছ থেকে পাওয়া জিনিসপত্রের কিছু ছবি ইসরাইলি সেনারা প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে সেখানে তসবি, আতর, কয়েকটি পুস্তিকা, চকোলেট, এবং একটি পাসপোর্ট রয়েছে।
শেষ লড়াইয়ের সময় তিনি বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হামাস প্রধানের মৃত্যু হামাসের জন্য বড় আঘাত হলেও যুদ্ধ থেমে থাকবে না। বরং হামাস লড়াই করেই যাবে এবং এখনও হামাসের হাতে শতাধিক ইসরাইলি সৈনিক বন্দি রয়েছে।
সিনওয়ারের শাহাদাতের মধ্য দিয়ে অবসান হল এক বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনপন লড়াইয়ের। বীর এবং দৃঢ় মুক্তিকামী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। দখলদার ইসরাইলিদের হাত থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তি ছিল তাঁর একমাত্র চাওয়া।
ALSO RAED:ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা, শেষ হবে কি গাজা যুদ্ধ?
জন্ম:
ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল মাজদাল আসকালানে। পরবর্তীতে দখলদার ইসরাইল যার নাম দেয় আসকেলন। ১৯৪৮ সালে পাশ্চাত্য রাষ্টকগুলির কবলিত রাষ্ট্রসংঘের ম্যানডেটের মাধ্যমে ইসরাইলের সৃষ্টি হয়। ফিলিস্তিনিদের ভূমি ও বসত-বাড়িসমূহ বিদেশ থেকে আগত যায়নবাদী ইসরাইলিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ইহুদিদের সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞের ফলে সিনওয়ারের পরিবারকে মাজদাল আসকালানে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গাজার খান ইউনিসে পালিয়ে যেতে হয়। সেখানে শরণার্থী শিবিরে তিনি কষ্টকর জীবন শুরু করেন।
কারাগারের জীবন:
সিনওয়ার প্রায় ২৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। ছাত্রজীবন থেকেই হানাদার ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। যে কারণে ছাত্রজীবনে একাধিকবার তাঁকে গ্রেফতার করে ইসরাইলি সেনারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালীন ইহুদি সেনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জেরে তাঁকে দ্বিতীয়বার ১৯৮৫ সালে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় জেলে হামাসের আধ্যাত্মিক গুরু শেখ আহমদ ইয়াসিনের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। দুই বছর পর শেখ আহমদ ইয়াসিন হামাস গঠন করলে সিনওয়ার তাতে যুক্ত হন এবং শুরু থেকেই ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক পন্থায় সমস্যা সমাধান অসম্ভব বিবেচনা করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেন।
১৯৮৮ সালে সিনওয়ারকে দুই ইসরাইলি সৈন্য এবং চারজন ফিলিস্তিনিকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
পরের বছর তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি ফিলিস্তিনি আন্দোলনের সময় সালাহ শেহাদের সঙ্গে যুক্ত হন। সালাহ শেহাদ সেসময় হামাসের কাসাম ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন। ২০০২ সালে ইসরাইলি বাহিনী সালাহ শেহাদকে গুলি করে হত্যা করেছিল। বন্দি অবস্থাতেই সিনওয়ার শিখেছেন হিব্রু ভাষা। হিফজ করেছেন পবিত্র কুরআন শরীফ। পাশাপাশি ভালোভাবে রপ্ত করেছেন ইসরাইলি কূটকৌশল ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।
কারাগার থেকে মুক্তি:
২০০৬ সালে একটি সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ইসরাইলের ভেতরে প্রবেশ করে হামাসের সামরিক শাখা ইজ আদ-দিন আল-কাসেম ব্রিগেডের কিছু যোদ্ধা। তারা ইসরাইলি আর্মির একটি চেকপোস্টে হামলা চালান এবং দুই সেনাকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় আহত হয় আরও বেশ কয়েকজন সৈনিক।
সেই হামলার সময় গিলাদ শালিত নামে এক ইসরাইলি সেনাকেও বন্দী করে নিয়ে আসেন হামাস যোদ্ধারা। এই গিলাদ শালিত প্রায় পাঁচ বছর হামাসের আস্তানায় বন্দি ছিলেন। পরে একটি বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় সিনওয়ারকে ২০১১ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ ২৩ বছর তাঁর ইসরাইলি কারাগারে কাটে।
ALSO READ:উপনির্বাচনঃ রাজের ৬ বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণা বিজেপির
সিনওয়ারের উত্থান:
তাঁর মুক্তির পরের বছরগুলিতে হামাসে সিনওয়ারের উত্থান ঘটতে থাকে। ২০১৫ সালে সিনওয়ারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের তালিকায় চিহ্নিত করে। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট সিনওয়ার গাজায় হামাসের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। সংগঠনের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়ার শাহাদাতের পর ক্ষমতায় আসেন সিনওয়ার।
২০২৩-এ ইসরাইল আক্রমণ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলার পরিকল্পনার জন্য সিনওয়ারকে অভিযুক্ত করেছে যায়নবাদী ইহুদি সরকার। ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচট সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইয়াহিয়া সিনওয়ার ছিলেন এ হামলার পিছনে মাস্টারমাইন্ড।’
তরজমা: ইমামা খাতুন
1 Comment
Pingback: অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী লিখেছিলেন অসমীয়া ভাষায় নবী জীবনী