পুবের কলম প্রতিবেদকঃ রবিবার মুসলিম ইন্সটিটিউটে কলকাতার বিশিষ্টজনদের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন কেন্দ্রের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সালমান খুরশিদ। মনমোহন সরকারের আমলে তিনি সংখ্যালঘু মন্ত্রকের দায়িত্বও পালন করেছেন। কলকাতায় তার কথা শোনার জন্য আগ্রহীরা হাজির হয়েছিলেন দুপুর একটার মধ্যেই। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য মাইনোরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান, রাজ্যসভার সাংসদ নাদিমুল হক, মুসলিম ইন্সটিটিউটের সম্পাদক নিসার আহমেদ, আনিস নাঈম প্রমুখ।
বর্ষিয়ান কংগ্রেস সালমান খুরশিদ এদিন দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও মুসলিমদের সামনে থাকা নানা সংকট নিয়ে বক্তব্য রাখেন। বহুদিন ধরে তিনি রাজনীতিতে আছেন। ইউপির আলিগড়ে জন্ম নেওয়া খুরশিদ সংসদীয় রাজনীতিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেনের তিনি নাতি। দেশের জনগণ ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে তাঁর স্বচ্ছ ভাবনা এদিন তিনি তুলে ধরেন সবার সামনে।
বাবরি মসজিদ, তাৎক্ষণিক তিন তালাক, নিকাহ-হালালার সত্য-মিথ্যা, বিজেপির মুসলিম বিরোধী প্রোপাগান্ডা—বেশকিছু ইস্যু তিনি ছুঁয়ে গেছেন তাঁর বক্তব্যে। তবে সাম্প্রতিক ওয়াকফ নিয়ে দেশে যে সমালোচনার ঝড় বইছে, তা নিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তিনি। সাংবাদিকদের সামনে সালমান খুরশিদ বলেন, ওয়াকফ নিয়ে কেন্দ্র যে নয়া বিল পেশ করেছে, তা অত্যন্ত বিতর্কিত ও ন্যক্কারজনক।
তিনি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেন যে ওয়াকফ সম্পত্তি আল্লাহর উদ্দেশে প্রদত্ত এবং এই ওয়াকফের আয় থেকে অর্থ মানুষের মঙ্গলের জন্য ও ধর্মীয় কাজ ব্যয় করার জন্য উৎসর্গকৃত। বিজেপি সরকার সেই প্রতিষ্ঠানের উপর আঘাত হানতে চাইছে। এই আঘাত শুধু মুসলিমদের উপর নয়, হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মের মানুষের উপরেও পড়বে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে বহু হিন্দু উপকৃত হচ্ছেন অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও লাভবান হচ্ছেন। তাই এই প্রতিষ্ঠানকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যখন এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত নিন্দাজনক। এটা অবশ্যই রুখে দিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রসঙ্গত, মিলিটারি ও রেলের পর ওয়াকফের জমিই সবচেয়ে বেশি রয়েছে দেশে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তিও রয়েছে ভারতে। ভারতে ৬ কোটি একর ওয়াকফ জমিন রয়েছে। এই সম্পত্তির পরিমাণ এত বিপুল যে এর সঠিক ব্যবহার করলে তা দেশের হিন্দু-মুসলিম সবার উন্নতিতে ব্যাপকভাবে কাজে লাগবে।
ওয়াকফ সম্পত্তির আয় এবং উপস্বত্ব থেকে সমাজ তথা দেশের অনেক জনকল্যাণমূলক কাজও হয়েছে এবং হচ্ছে এখনও। কোথাও বিনা খরচে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চালানো, ছাত্রছাত্রীদের জন্য হস্টেলের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য শিবির, এতিমখানা, মসজিদ, কবরস্থান ইত্যাদি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ—এই রকম বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজও ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে নির্বাহ করা হয়।
দেশে মুসলিমদের সম্পর্কে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের মানুষরা খুব কম জানে বলেও সালমান খুরশিদ উল্লেখ করেন। এ জন্য সালমান খুরশিদ মুসলিমদের এগিয়ে এসে অমুসলিম ভাইদের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তাঁর মতে, মুসলিমদের সম্পর্কে না জানার জন্যই মোদি যা বলেন হিন্দুরা তা-ই বিশ্বাস করে বসেন। হিজাব কেন পরতে হয়, হিন্দুরা জানে না। আমরা তাঁদের কাছে শারীয়া আইন এবং ইসলামের অনেক মেসেজই তুলে ধরতে পারিনি। অমুসলিম ভাইরা জানলে হিজাব বিতর্ক সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছাতো না।
আমাদের বলা উচিত হিজাব শুধু ধর্মীয় প্রথা নয়, নারী মর্যাদা ও সম্মানের দিক থেকেও সবার জন্য হিজাবের গুরুত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ইউরোপ সফরে মসজিদের আরব ইমামের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাৎক্ষণিক তিন তালাক সম্পর্কে ওই ইমাম বলেন, এক বৈঠকে তাৎক্ষণিক তালাক তিনবার নয়, একশোবার দিলেও তা এক তালাকই গণ্য হবে। অথচ তালাক নিয়ে নানা বিতর্ক হল। বিজেপি সরকার এমন কোনও ডেটা কিন্তু দিতে পারেনি যেখান থেকে জানতে পারা যাবে তাৎক্ষণিক তিন তালাক দেশে নিষিদ্ধ হওয়ার পর মুসলিম মেয়েরা আগের চেয়ে ভালো আছে।
কিংবা ক’জন স্বামীকে জেলে পাঠানো সম্ভবপর হয়েছে। আর স্বামী জেলে থাকলে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণ ও শিক্ষার দায়িত্ব কে নেবে? এছাড়া জেল থেকে ফিরে এলে ওই স্বামীর তো পুনরায় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবে। না হয় সে আবার জেলে যাবে। সমস্যা কিন্তু রয়েই যাবে। মুসলিম আইন নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে মুসলিমদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোট হয়েছে। একে পারস্পরিক ত্যাগের ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সালমান খুরশিদের এই সফরে কলকাতার কিছু মুসলিম তাঁকে দিল্লির ‘ইন্ডিয়া ইসলামিক কালচারাল সেন্টার’-এর অধীনে কলকাতায়ও একই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আবেদন জানান।
উল্লেখ্য, সালমান খুরশিদ সম্প্রতি দিল্লিতে অবস্থিত ভারতের মুসলিমদের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়া ইসলামিক কালচারাল সেন্টার’-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এ সম্পর্কে খুরশিদ বলেন, বাংলার মুসলিমদেরই ‘ইন্ডিয়া ইসলামিক সেন্টার’-এর মতো প্রতিষ্ঠান কলকাতায় নির্মাণ করতে হবে। এর পরিচালনাও তাঁরাই করবেন। দিল্লির ‘ইন্ডিয়া ইসলামিক কালচারাল সেন্টার’ কলকাতার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।
সালমান খুরশিদ আরও বলেন, দেশবাসীর প্রচেষ্টায় শাসকদের উগ্রপন্থী অংশকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারলেও তাদের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাকে আটকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলিমদের বড় ভূমিকা রয়েছে। রাজনীতিকে এখন এভাবে নিয়ে যেতে হবে যেন ফ্যাসিবাদ পুনরায় শক্তিশালী হতে না পারে।
এরপর অভিমত বিনিময়ের সময় কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকরা কিছু প্রশ্ন তোলেন। অসমে মুসলিমদের উপর অত্যাচারের কথাও উঠে আসে। আহমদ হাসান ইমরান সালমান খুরশিদ সাহেবকে বলেন, কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধি গাজায় ইসরাইলি বর্বরতার বেশ কয়েকবার নিন্দা করেছেন। এ জন্য তিনি ধন্যবাদের যোগ্য। এছাড়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন নাদিমূল হক, নিসার আহমেদ, ইমরান প্রমুখ।