সোনিয়া তাসনিম খান
হাজারো ভাষা, বর্ণ, গোত্র, জাতি ও ধর্মে বিভক্ত উপমহাদেশ আর সেইসঙ্গে বিশ্বকেও এক টেবিলে বসাতে পারে মাত্র দুটো জিনিস। একটি হল ব্যাটে বলে ক্রিকেট আর অন্যটি হল বিরিয়ানি। আর শাহী খানা বিরিয়ানি মানেই জিভে জল, রসনায় তৃপ্তি না, নাসারন্ধ্রও বাদ নেই। বিরিয়ানির খুশবুতে নাকতো বটেই, মাতোয়ারা হয়ে ওঠে চারদিক। আর বিভিন্ন শহরে বিরিয়ানি স্বাদগন্ধ ও রংয়ের নিজস্বতা নিয়ে এক একটি ঘরানা গড়ে তুলেছে। এই ঐন্দ্রজালিক বিরিয়ানির জুড়ি মেলা ভার।
ভারতবর্ষের চারশ বছরের বর্ণিল ইতিহাসের অধ্যায় থেকে আরম্ভ করে আজ অবধি এই বৈচিত্র্যময় উপমহাদেশে মশলাদার স্বাদও খুশবুযুক্ত অমৃত খাদ্যটির জনপ্রিয়তা তাই আজও সমানভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার শুনুন, মুখরোচক বিরিয়ানির সাতকাহন কথা।
কথা শুরু করবার আগে একটু ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক। বিরিয়ানির সূচনা ভারতে কি করে হল এই নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। বলা হয়, বিরিয়ানির উৎপত্তি মূলত এশিয়ার পশ্চিমাংশ থেকে। তুর্কি মোঙ্গল বিজয়ী তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস ১৩৯৮ সালে বিরিয়ানিকে ভারতের সীমানায় পৌঁছে দেন। মতান্তরে, ভারতের মালাবারে দক্ষিণ উপকূলে তুরস্ক ও আরব ব্যবসায়ীদের আনাগোনার সাথেই ভারতবর্ষে এর আগমন ঘটে।
তবে, এই ‘বিরিয়ানি-যাত্রায়’ মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কেউ জানেন কি? এই মুঘল সুন্দরী তাজমহলের শুভ্রতায় পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যকে সমৃদ্ধ করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূ-ভারতের স্বাদের ঐতিহ্যকেও করে তুলেছেন ঐশ্বর্যশালী। শোনা যায়, একবার মুমতাজ বেগম মুঘল সৈন্যদের অবস্থা পরিদর্শনে ব্যারাকে যান এবং সেখানে তিনি সৈনিকদের স্বাস্থ্যের করুণ অবস্থা দেখে ব্যথিত হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মেসের বাবুচিকে স্বয়ং নির্দেশ করেন চাল ও গোশত সমৃদ্ধ এমন পুষ্টিকর খাদ্য তৈরি করতে যা তাঁর সেনাবাহিনীদের স্বাস্থ্যকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। সম্রাজ্ঞীর ফরমায়েশে বাবুচি যে মুখরোচক খাবারের রেসিপি তৈরি করে এবং পরে তাকে পাত্রে উপস্থাপন করেন, সেটাই বিরিয়ানির তকমা অর্জন করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাদের প্রতিযোগিতায় উত্তর দিয়ে মুঘলদের টেবিলে জায়গা করে নিতে জিভে জল আনা এই চাল-মাংসের সংমিশ্রণটির কিন্তু খুব বেশি সময় লাগেনি। ভারতের আনাচে-কানাচে এর বৈচিত্র ছড়িয়ে দিয়েছে মুঘলরাই। আরস্থানভেদে এটি এর প্রণয়ন-শৈলী আর উপস্থাপনা পেয়েছে নতুনত্বের ছোঁয়া। তাইতো পূর্বে ঢাকা থেকে পশ্চিমের পেশোয়ার অবধি ঘোড়া ছোটালে পাওয়া যাবে কিছু তারতম্য সহ এই বিরিয়ানির বৈচিত্র্য।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরও একটা ছোট্ট তথ্য দিই। বিরিয়ানি গোটা ভারতবর্ষে দাবড়ে বেড়ালেও এই শব্দটির মালিকানার সুতো কিন্তু সূদূর পারস্য সম্রাজ্যের লাটাই-এর সঙ্গে যুক্ত। ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ মানে ‘রান্নার আগে ভেজে নেওয়া’ আর ‘বিরিঞ্জ’ অর্থ হল ‘চাল’। তাহলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে, রান্নার আগে ঘি দিয়ে সুগন্ধি চাল ভেজে নেওয়ার কারণেই এর নাম ‘বিরিয়ানি’।
যদি প্রশ্ন করা হয়, বিরিয়ানি কত প্রকার, তবে এর সঠিক উত্তর বলা মুশকিল। সারা পৃথিবীতে প্রায় কয়েকশ বিরিয়ানি তার স্বাদের রাজত্ব করে চলছে। তবে নামে পার্থক্য থাকলেও; রন্ধন প্রক্রিয়া মোটামুটি একই। বিরিয়ানির আসল বৈচিত্র্য খেলা করে এটার মাঝের বাহারি মশলার ব্যবহারে। আর সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার, এই খাবারটির স্বাদের মূলমন্ত্র হল, মাংস ও চাল চুলোয় বসিয়ে দম দিয়ে রান্না করার কৌশল। তবে জগৎ বিখ্যাত কিছু বিরিয়ানির নাম যদি বলতেই হয়, তাদের মাঝে হায়দরাবাদি, সিন্ধি, লখনউ, লাহোর, মুম্বই, কলকাতা, ঢাকা উল্লেখযোগ্য।
ভারতীয় উপমহাদেশে কাচ্চি ও পাক্কি দু’ ধরনের বিরিয়ানির প্রচলন থাকলেও কাচ্চি বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। যেহেতু সুগন্ধি চালের সঙ্গে গোশত সরাসরি রান্না করা হয়, তাই এর নাম ‘কাচ্চি’। উর্দু শব্দ ‘কাচ্চা’-র বিবর্তিত রূপ ‘কাচ্চি’। যার অর্থ হল ‘কাঁচা’। চাল, কাচা আলুর ওপর টকদই ও মশলায় মেখে রাখা কাঁচা মাংসের আস্তরণের স্তূপকে হাঁড়িতে রেখে ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে ‘দমে’ রান্না করা হয়। প্রোটিনের পুষ্টি গুণের এই মিশেল ঘি, জাফরান, গোলাপজল, কেওড়াজলে সিক্ত হয়ে, দমে প্রস্তুত হয় এই অতুলনীয় কাচ্চি। আর ঢাকাই কাচ্চি নিয়ে আলাদা করে কোনও পরিচয় বা বিশেষণ দেওয়া একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। কেন বলছি? বস্তুত মুঘলদের জাদুকরী ব্যঞ্জনশিল্পে সওয়ার হয়ে যত রকমের মোগলাই খাবার ঢাকায় আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে তার মাঝে বিরিয়ানি চোখ বুজে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবিদার। ইতিহাসের সোনালি পাতার আলোকে, ১৯৩৯ সালে হাজী গোলাম হোসেন সাহেবের বনেদী হাত ধরে ঢাকাতে শুরু হয় বিরিয়ানির অগ্রযাত্রা। মূলত হাজীর বিরিয়ানি থেকেই ঢাকায় জন্ম নেয় এই মশলাদার শিল্প। মোলায়েম গোশত আর সুগন্ধি চালের এই গ্রাস একবার যে মুখে তুলেছেন, কেবলমাত্র তিনিই অনুধাবন করতে পারবেন এর মর্মার্থ। পুরোন ঢাকার ফখরুদ্দিন,চানখারপুলের হাজী নান্না, নারিন্দার ঝুনুর বিরিয়ানি রীতিমতো ‘লিজেন্ড’-এর ঝাণ্ডা বহন করে চলছে বছরের পর বছর ধরে। ঢাকাই কাচ্চিকে তাই বলা হয়, বাংলাদেশের রাজধানীর অন্যতম ট্রেডমার্ক।
এই উপমহাদেশের খাদ্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে ঢাকাই বিরিয়ানির ঐতিহ্য এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে। বর্তমানে কেবল নতুন-পুরোন ঢাকার সুড়ঙ্গ পথেই নয়, ঢাকাই বিরিয়ানির নির্যাস ছড়িয়েছে শহর থেকে শহরে এমনকি ভৌগোলিক সীমারেখা পার করে সুদূর প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে। খবরের কাগজের পাতা থেকে শুরু করে ওয়েব দুনিয়ার ভার্চুয়াল পর্দায় এর স্তুতি। পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের পছন্দের খাদ্য তালিকায় সর্বদা শীর্ষে থাকা এই বিরিয়ানির কদর বলতে গেলে সত্যি ঈর্ষণীয়। যার অনবদ্য স্বাদ আর অনিবচনীয় উপস্থাপনার সঙ্গে অনায়সে জুড়ে যায় আপ্যানকারীর শাহী রুচিবোধ, মানমর্যাদা আর শান-শওকাত। জাদুকরী এই ব্যঞ্জন স্বাদ গাঁথায় অতি সহজেই জুড়ে যায় সম্পর্কের নব নকশিকাঁথা। ভাপে বসানো সুবিশাল হাঁড়ির মাঝে থেকে ভুরভুরিয়ে বেড়িয়ে আসা বিরিয়ানির সুগন্ধে উদ্বেলিত বাতাস বয়ান করে যায় এর অলিখিত অতুলনীয় স্বাদের উপাখ্যান। তাতে সার্থক মুচকি হাসির রেখা জেগে ওঠে রাজকীয় পৃষ্ট গোঁফে তা দেওয়া দক্ষ বাবুর্চির ঠোটের হাসির কোণে। আর, ভোজন রসিকদের আমোদের কথা না হয় নাই বা বললাম। সেকথা বরং থালি পর্বের জন্যই তোলা থাক। বিবেচনা আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। আসলে মহাশয়, এটা এমন আখ্যান, যা শুধু মাত্র জিভের পরখেই বর্ণনা করা সম্ভব, কলমের কালিতে নয়। তবুও বিখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় অগত্যা বলে নেওয়ার দুঃসাহস করেই নিচ্ছি, একি ভানুমতি! একি ইন্দ্ৰজাল!
ভেজ বা নিরামিশ ভোজীরা দুঃখ করছেন তো! এমন দুর্লভ ও মহার্ঘ স্বাদের বিরিয়ানির আস্বাদন আপনাদের কপালে জুটলো না। দুঃখ করবেন না। আপনাদের জন্যও কিন্তু রয়েছে ভেজ বিরিয়ানি। বেস্ট ভেজ বিরিয়ানি বোধহয় পাওয়া যায় চেন্নাই শহরে। ব্যাঙ্গালুরুও কম নয়। আসলে ‘ভেজি’-র সংখ্যা তো সেখানেই বেশি। ভেজ বিরিয়ানির স্বাদও কিন্তু অতুলনীয়।