বিশেষ প্রতিবেদনঃ পবিত্র মক্কা শরীফ ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক শহর। দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মক্কা শহর পবিত্র বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই মক্কা ও মদীনা শরীফ ছিল ওসমানিয় (অটোমান) তুর্কিদের দখলে। এই অঞ্চলকে সে সময় বলা হত হেজায। তুর্কি খলিফারা হেজাযের শাসনভার ন্যস্ত করেছিলেন আল্লাহ্-র নবীর সময়ের সেই বানু হাশিম গোত্রের বংশধরদের হাতে। তুর্কি খলিফার নিযুক্ত মক্কার শেষ শাসক ছিলেন হোসেন বিন আলি-আল হাশমি। তাঁকে প্রথাগতভাবে ‘মক্কার শেরীফ’ বলা হত। ১৯১৬ সালে তিনি মক্কার শেরীফ নিযুক্ত হন। কিন্তু মক্কার এই শেরীফ হোসেন বিন আলি-আল হাশমি ইংরেজদের সঙ্গে মিলে মুসলিম বিশ্বের খলিফা আবদুল হামিদ (দ্বিতীয়)-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। পরিণতিতে জেরুসালেম-সহ আরবের বিভিন্ন অংশে ব্রিটিশ ও পরবর্তীতে ইসরাইলি শাসন কায়েম হয়। এরপর আবদুল আজিজ ইবনে সউদ ব্রিটিশদের সহায়তায় সমগ্র আরবের উপর দখলদারি কয়েম করেন। সউদরা ছিলেন মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব-এর শিষ্য। আবদুল ওহাব যেসব মতবাদ ব্যক্ত করতেন তার সঙ্গে সুন্নি ইসলামের বহুলাংশে কোনও মিল ছিল না। ইবনে সউদ এবং আবদুল ওহাব ‘শির্ক হবে– এই বলে’ মক্কা– মদীনায় ইসলাম ও নবী (সা.)-র মুহাম্মদের স্মৃতি বিজড়িত বহু ভবন ও মসজিদ ধ্বংস করেছিলেন। জান্নাতুল বাকিতে অবস্থিত সাহাবাদের (রা.) বহু কবর তারা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়– যাতে কেউ আলাদা করে কোনও সাহাবার কবর চিহ্নিত করতে না পারে।
এরপর থেকে তারা মক্কা ও মদীনার বহু ঐতিহাসিক স্থান ও ইসলামের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত বহু ভবন ও সৌধ মিসমার করে সেখানে হোটেল– মল ও নিজেদের আলিশান ভবন নির্মাণ করতে থাকে। এই সিলসিলা এখনও জারি রয়েছে। যারা ২০ বছর আগেও মক্কা ও মদীনায় গেছেন– তাঁরা মোটে এখন এই নগরী দু’টিকে চিনতে পারবেন না। আধ্যাত্মিকতা ও নবী (সা.)-র স্মৃতি ও ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করে সউদিরা মক্কা ও মদীনাকে শুধুই বাণিজ্যিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
বিগত ১০০ বছরে ইসলামের পবিত্রতম স্থানে কি ধরনের পরিবর্তন হয়েছে– সেই সম্পর্কে গোলাম রাশিদ সংগৃহীত প্রাথমিক এক প্রতিবেদন
মক্কা শরীফ ইসলাম ধর্মের পবিত্র নগরী হিসেবে স্বীকৃত। এই শহরে মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম এবং এখানেই তিনি কুরআনের প্রথম ওহী লাভ করেন (বিশেষভাবে– হেরা গুহায় যা শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে)। সারা বিশ্বের মুসলিমরা প্রতি বছর হজ ও উমরাহ পালনের জন্য এখানে আসেন। মক্কার প্রাণকেন্দ্রে কাবা অবস্থিত। সোনালি-রূপালি অক্ষরে পবিত্র কুরআনের বাণীখচিত কালো গিলাফ দিয়ে ঢাকা এই ঘরের দিকে মুখ করেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলাম অনুসারীরা নামায পড়েন। শত শত বছর ধরে হাজিরা এখানে হজ করতে আসছেন। একসময় পানি-জাহাজে করে– উটে চেপে হাজিরা মক্কায় আসতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই যাত্রার বাহন বদলেছে। এখন আকাশপথেই মক্কা শহরে নামেন বেশির ভাগ হজযাত্রীরা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলেছে শহরের রূপও।
তখন মক্কার এই অংশের আরব ভূমিকে বলা হত হিজাজ। এই হিজাজ ছিল তুর্কির ওসমানিয় (অটোমান) খিলাফতের অধীনে। তবে দীর্ঘদিন এই শহর মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধররা শাসন করেছেন। ১৯২৫ সালে এক বেদুইন সরদার ইবনে সউদ-এর মাধ্যমে সউদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সউদি বংশ মক্কার দায়িত্ব লাভ করে। বর্তমানেও উক্ত রাজবংশ মক্কা শাসন করছে।
আধুনিক যুগে এসে এই শহর বহুগুন সম্প্রসারিত হয়েছে। এর অবকাঠামো– রাস্তাঘাট– নাগরিক সুবিধা ইত্যাদির অনেক উন্নতি লক্ষ করা যায়। পূর্বে কাবার আশেপাশের স্থানগুলিতে অত বড় বড় উঁচু বাড়ি-ঘর ছিল না। শহর সম্প্রসারণের কারণে অনেক ঐতিহাসিক কাঠামো এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন– যেমন আইয়াদ দুর্গ সউদিরা ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন তীর্থযাত্রী মক্কা শরীফে আসেন। ফলশ্রুতিতে শহরটি সারা বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিশ্বজনীন শহরে পরিণত হয়েছে।
আল জাজিরা ওয়েবসাইট পবিত্র মক্কা এবং আল্লাহর ঘরের প্রায় ১০০ বছরের প্রাচীন ছবি প্রকাশ করেছে। পবিত্র মক্কা ও আল্লাহর ঘরের ১০০ বছরের প্রাচীন এ ছবিগুলো দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে– বিগত ১০০ বছরে পবিত্র মক্কা নগরীর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এর আধুনিকীকরণ করতে গিয়ে ৬০১ মিটার উঁচু মক্কা রয়্যাল ক্লক টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। ‘আবরাজ আল বাইত’ নামের এই বিলাসবহুল হোটেল নির্মিত হয়েছে কাবা শরীফের গা ঘেঁসে। মক্কায় ঢুকলে বিশ্বের বৃহত্তম এই ক্লক টাওয়ারটিই প্রথমে চোখে পড়বে এখন– নজরেই আসবে না মসজিদুল হারামের মিনার কিংবা কাবা শরীফ। ওই হোটেল কমপ্লেক্সটি আইয়াদ দুর্গ ধ্বংসের পরে নির্মিত হয়েছিল– যা ১৮ শতকের একটি তুরস্ক নির্মিত অটোমান দুর্গ ছিল। পবিত্র মক্কা শরীফের সুরক্ষার জন্যই এই দুর্গ নির্মিত হয়েছিল। যেটি এই মসজিদুল হারাম থেকে দেখা যেত। ২০০২ সালে সউদি সরকারের এই দুর্গ ধ্বংস করা নিয়ে তুর্কিরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এখন আধুনিকীকরণ ও সংস্কারের নামে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিনোদনের জন্য সে দেশের পর্যটক ও নাগরিকরা যাতে দেশের বাইরে গিয়ে অর্থ ব্যয় না করে– সেজন্য সউদি আরব আগামী পাঁচ বছরে পশ্চিমা বিনোদন আর গ্ল্যামারের দুনিয়া সউদি আরবে উন্মুক্ত করে দেবে। আর এই কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে সউদি সরকার সিনেমা হল আর বিনোদন কেন্দ্রগুলো চালু করেছে। তায়েফে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র এবং অর্থনৈতিক জোন হিসেবে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের একটি শহর গড়ে তোলার বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। শহরটির নাম ‘নিওম’ হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নাইট ক্লাবও চালু করেছে এই সউদি রাজপুত্র। মক্কা শহর বিশ্বের কাছে পবিত্র ও মর্যাদাবান এক শহর। সেই শহরের আধ্যাত্মিকতা ও মর্যাদাকে ভূ-লুণ্ঠিত করা হচ্ছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।