পুবের কলম প্রতিবেদকঃ সুর ও কণ্ঠের অনন্য মিশেলে লতা মঙ্গেশকর যেমন হয়ে উঠেছিলেন ‘নাইটেঙ্গেল’। তেমনই নুরজাহান হয়ে উঠেছিলেন মালিকা-এ-তারান্নুম (সুর সম্রাজ্ঞী)। আজ দু’জনেই নেই। আছে কেবল তাদের অগণিত গান। যা হয়তো থেকে যাবে কায়ামত পর্যন্ত। তখনও লতাকে মানুষ তেমন করে চিনতেন না। কিন্তু মালিকা-এ-তারান্নুম ততদিনে অখণ্ড ভারতে জনপ্রিয়। তাঁর কন্ঠের মাধুর্য যেমন মনকে ভরিয়ে দিত, তেমনই তিনি নিজেও ছিলেন অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী। লতা নিজে বলেছিলেন কম বয়সে তাঁর রোল মডেল ছিলেন নুরজাহান। তিনি তাঁর গায়কী নকল করার চেষ্টাও করেছেন কিছুদিন। নূরজাহানের জন্ম ১৯২৬-এর ২১ সেপ্টেম্বর।
নুরজাহান নামে খ্যাতি পেলেও তাঁর আসল নাম ছিল আল্লাহরাখি। পাঞ্জাবি মুসলিম পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ২০০০ সালের ২৩ ডিসেম্বর নুরজাহান সংগীত জাহানকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন। দেশভাগের পর পাকিস্তানের প্লেব্যাক গানে তিনি রাজত্ব করেছিলেন টানা ৩৩ বছর।
আমাদের লতার জন্ম ১৯২৯-এর ২৮ সেপ্টেম্বর। বয়সে তিনি নুরজাহানের থেকে কিছু ছোট। তবে নুরজাহান সঙ্গীতের জাহানে ত দ্রুত আলো ছড়াতে শুরু করেছিলেন যে লতাও অনুসরণ করতেন। নিখুঁত উর্দু উচ্চারণের মিশেলে চল্লিশের দশকে দ্যুতি বা নূর ছড়িয়েছিলেন নুরজাহান।
স্বয়ং সাদাত হাসান মান্টো তাঁর বই ‘মান্টো নামায়’ নুর জাহানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কিংবদন্তি শিল্পী গুলাম হায়দরের কাছে প্রশিক্ষিত নুর জাহান ততদিনে ‘খানদান’, ‘নওকর’, ‘দোস্ত’ সিনেমায় গান গেয়ে মশহুর। এমন সময়েই উঠে আসেন লতা। শুরু থেকেই লতা জানান দিয়েছিলেন, তিনিও সুরের জগত্তে রাজত্ব করতেই এসেছেন। তাঁর প্রথম দিকের গান শুনে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান, গুলাম হায়দরের মতো সঙ্গীতশিল্পীও ভবিষ্যতের তারকাকে পড়ে ফেলেছিলেন। নুরজাহান ৪০টি ছবিতে প্রায় ২০ হাজার গান গেয়েছেন।
একবার লতা নিজে বলেছিলেন, বলতে দ্বিধা নেই, প্রত্যেকের যেমন রোল মডেল থাকে, আমার আদর্শ ছিলেন নুরজাহান। ছোটবেলা থেকে ওঁর গান শুনে বড় হয়েছি। ওঁর গানের নোটস মনে গেঁথে গিয়েছিল।’ নুরজাহান বার বার স্বীকার করেছেন, লতার প্রতিভায় তিনি মুগ্ধ। নিছক প্রশংসা নয়, একে অপরের সম্পর্কও ছিল মধুর।
দেশ স্বাধীন এবং বিভক্ত হওয়ার পরে তখন বছর চারেক কেটে গিয়েছে। এমন সময়ে এক বার অমৃতসরে গানের রেকর্ডিংয়ে যাচ্ছিলেন লতা। মুখ্য উদ্দেশ্য সঙ্গীত হলেও নুরজাহানের সঙ্গে অন্তত এক বার দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি। দুদেশের মাঝে ততদিনে কাঁটাতার পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু তারের বেড়া কি ভালোবাসাকে রুখতে পারে?
মুখ্য উদ্দেশ্য সঙ্গীত হলেও নুরজহানের সঙ্গে এক বার দেখা করতে মন উচাটন ছিল। শুধু একবার দেখা। টেলি যোগাযোগ তখন এত সহজ ছিল না। তা সত্ত্বেও নুরজাহানকে টেলিফোন করেন লতা। তিনি তখন লাহোরে থাকতেন। সেখান থেকে ছুটে আসেন মালিকা-এ-তারান্নুম। দুই দেশের কাঁটাতার যেখানে নেই, এমন নো-ম্যান্সল্যান্ডে দু’জন দেখা করেন। জড়িয়ে ধরেন দু’জনকে। সময় যেন দুই তারকার আলিঙ্গনে থমকে ছিল। তারকাদের চোখে আবেগের জল। কেউ যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তা দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদেরও কেউ কেউ। তাদেরও চোখে জলে চিকচিক করে উঠেছিল। বহু বছর পরে ১৯৮২ সালে কনসার্টের জন্য মুম্বই (তখন বম্বে) আসেন নুরজহান। অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেন লতা। কাছে আসেন দুই মহারথী।
পাকিস্তানের ভিতরে জন্মলগ্ন থেকেই একটা অস্থিরতা ছিল। কিন্তু আজকের ভারতের বাতাস বিদ্বেষ বিষে ভরিয়ে দেওয়ার অশুভ চেষ্টা হচ্ছে। হিন্দুত্ব বিদ্বেষের সমার্থক করে প্রচার করা হচ্ছে। সব কিছুকেই হিন্দু-মুসলিম দুই মেরুতে ভাগ করা হচ্ছে। সেটা কেবল রাজনীতির গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তাকে নস্যাৎ করা যেত। কিন্তু এই বিদ্বেষ ও বিভাজনকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের মতো বৌদ্ধিক ক্ষেত্রগুলিতে। কাঁটাতারের বেড়াকে প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও সৌজন্য দিয়ে একসময় কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীরা
আজ আর সাহস করছেন না কেউ। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতীয়তাবাদের শত্রু।
এখন এদেশে জাতীয়তাবাদের নাম করে এদেশে যে ছদ্ম জাতীয়তাবাদের স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, তাতে বিদ্বেষের পাল্লায় ভারি। দেশপ্রেম খুঁজে পাওয়া ভার। সবক্ষেত্রে কেবল জিতে যাচ্ছে কাঁটা। আর সেই সেই কাঁটার আঘাতে প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা-সুর-শিল্প। এমন বিদ্বেষপূর্ণ প্রেক্ষাপটেও চির অম্লান হয়ে থাকবে লতা-নুরজাহানদের ভালোবাসার স্মৃতি।