নিজেদের ‘ভারতীয়’ প্রমাণের দায়ে অসমে ২০ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে!

- আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার
- / 5
বিশেষ প্রতিবেদন: একটি উন্নয়নশীল ভারতে, নিজেদের ‘ভারতীয়’ প্রমাণ করার জন্য লড়াই জারি রয়েছে। অসমে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ বা জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি মানুষের নাগরিকত্ব বর্তমানে প্রশ্নের মুখে। কারণ ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ না দিতে পারলে তাদের যেতে হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। ফলে ভারতীয় প্রমাণ করার তাগিদ এখন এক ঝুঁকির কারণ হয়েছে দাঁড়িয়েছে।
ভয় আতঙ্ক ফুটে উঠেছে, অসমবাসী কৃষ্ণ বিশ্বাসের মুখে। বিশ্বাসের ভয়, তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হতে পারে। কৃষ্ণ জানিয়েছেন, তার ঘর থেকে কিছুটা দূরেই বাঁশ দিয়ে ঘিরে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। কৃষ্ণ বিশ্বাস আরও জানান, তার জন্ম অসম রাজ্যে। তার বাবার প্রায় ৬৫ বছর আগে এখানে জন্মেছিলেন। কিন্তু সরকার বলছে, আমাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হলে, ১৯৭১ সালের আগের নথিপত্র জমা দিতে হবে। অর্থাৎ, ৩৭ বছর বয়সী সবজি বিক্রেতা কৃষ্ণ বিশ্বাসকে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে হলে এক দশকের পুরনো দলিল, জন্ম শংসাপত্র সহ সব নথিপত্র সব দাখিল করতে হবে।
তবে এই তালিকায় বিশ্বাস একা নয়। প্রায় ২০ লক্ষ বা অসমের জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি মানুষ তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আতঙ্কে ভুগছেন। অর্থাৎ আগামীদিনে ভারতীয় প্রমাণ করতে না পারলে, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হতে পারে।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘকাল ধরেই অসমে ভারতীয় কারা, সেই নিয়ে চাপান-উতোর চলে আসছে। কিন্তু বর্তমানে সেই বিষয়টি অনেকটাই বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য চাপা পড়ে গেছে।
এমন একটি সময়ে যখন ভারত চিনকে সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে, সেই সময় এই উদ্বেগগুলি আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার, ‘নির্বাচন’কে সামনে রেখে জাতীয়বাদি অনুভূতি, অবৈধ অভিবাসন ইস্যুগুলিকে কাজে লাগাতে চাইছে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি দেশব্যাপী একটি অনুরূপ নাগরিকত্ব যাচাইকরণ কর্মসূচি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে অসমে প্রক্রিয়াটি ফেডারেল অডিট ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হওয়ার পরে আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ১০০’র বেশি মানুষ ভারতীয় প্রমাণ না পারার জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি, ফলে তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। সরকার এই ক্যাম্পের পোশাকি নাম রেখেছেন ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’। সেখানে বহু মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। আতঙ্কে ইতিমধ্যেই বহু মানুষ ভারতের অন্য রাজ্যে পালিয়েছে, আবার অনেকে আত্মহত্যা করেছে।

কৃষ্ণ জানিয়েছেন, আমার বাবা, ভাই এখানে জন্মেছিলেন। আমরা এখানে জন্মেছি। আমার সন্তানেরাও এখানে জন্মেছে। আমাদের জন্ম এখানে, আমরা এই মাটিতেই মরতে চাই, এখান থেকে আমরা যাব না। অসমের ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশে মুরকাতা গ্রামে নিজের ভিটেতে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলি বলতে থাকেন কৃষ্ণ। বিশ্বাস পরিবারে ১১ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় ৯ জনেরই নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে।
নাগরিকত্বের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া একটি বিদেশি ট্রাইব্যুনাল তার স্ত্রী এবং মাকে ভারতীয় ঘোষণা করেছে। তার তিন সন্তান, তার বাবা এবং তার ভাইয়ের পরিবার সহ অন্যদের অভিবাসী আখ্যা দিয়েছে। বিশ্বাসের প্রশ্ন, সবাই তো একই জায়গায় জন্মেছে তাহলে কিভাবে একজনকে অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দেওয়া হল? তবে অর্থ সংকটে ট্রাইব্যুনাল বা উচ্চ আদালতে তাদের মামলা করতে পারেনি তার পরিবার। বিশ্বাস আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, যদি আমি ভারতীয় না হই, তাহলে আমাকে আর আমার পুরো পরিবারকে সরকার মেরে ফেলুক।
কৃষ্ণ বিশ্বাসের মতো বহু মানুষের অসমে ভারতীয় প্রমাণ করা বর্তমানে এক দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু মানুষের কাছে নিজেদের পরিচয় রক্ষার জন্য শুধু ভোটার কার্ডই ভরসা। কিন্তু সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণে পূর্ব পুরুষদের ১৯৭১ সালে নথি দেখাতে হবে। কারণ বিজেপি শাসনাধীন অসম সরকারের দাবি, যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সেই বহু মানুষ এখানে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে।
প্রসঙ্গত, অসমে জাতিগত বিভেদ আজকের ঘটনা নয়। জাতিগত বিভেদের আবেগেকে সামনে রেখে নেলি গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এই হত্যাযজ্ঞে সরকারি মতে দুহাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বেসরকারি মতে এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বাংলাভাষী মুসলিম।
এইভাবে ফয়জল আলিকে বহিরাগত ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। ২০১৯ সালে আলি জামিনে মুক্তি পান। সেই মাসের মার্চ মাসেই স্ত্রী, মানসিক অসুস্থ ছেলে দুই পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনীদের রেখে ইন্তেকাল করেন তিনি। আলির পরিবারের সকলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহারি গ্রামে থাকে। সকলকে বহিরাগত ঘোষণা করেছে সরকার। স্বামীর মৃত্যুর পর ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছেন আলির স্ত্রী। ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধার প্রশ্ন, আমি তো এখানকার নাগরিক ওরা তাড়িয়ে দিলে আমি এখন কোথায় যাব? এই তালিকায় আছেন আসিয়া খাতুনও। যার স্বামী ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী।
অসমে অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অভিবাসীদের আগমন অসমে পরিচয়ের জন্য একটি হুমকি। আমরা অবৈধ বাংলাদেশিদের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো থাকতে পারি না। এটা আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্ন’।