বিশেষ প্রতিনিধি: মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধান বিতর্ক তো বটেই। বিভিন্ন সময় বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর কদর্য রূপ দেখা গেছে ফ্রান্সে। এখন ভারতেও বিভিন্ন রাজ্যে এর বহির্প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। সবথেকে বিস্ময়ের কথা, প্রগতিশীল রাজ্য পশ্চিমবাংলাতেও হিজাব বিরোধী সাম্প্রতিক এক ঘটনা কলকাতা হাইকোর্টে পৌঁছছে। পশ্চিমবাংলার ঘটনায় দেখা গেছে, হিজাব কিন্তু বোরখা নয়। মুসলিম ধর্মীয় রীতি এবং বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী কয়েকজন মুসলিম তরুণী আবেদন করেছিলেন কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায়। বাংলায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বহু জেলায় হিন্দু মহিলারাও মাথায় ঘোমটা ব্যবহার করেন। আবেদনকারী এই মুসলিম তরুণীরাও ঘোমটা বা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা আবৃত করেছিল। দুই একজন ওড়না দিয়েও মাথা ঢেকে রেখেছিল। কিন্তু তাঁদের মুখ সম্পূর্ণ অনাবৃত ছিল। তাঁরা নিজেদের আবেদন পত্রে ‘পরিচিতি ফটো’ হিসাবে এই ছবি সংযুক্ত করেন। আর এতেই এই মুসলিম তরুণীরা কোপে পড়ে পুলিশ রিত্রুটমেন্ট বোর্ড কর্তৃপক্ষের। তাঁরা এই মাথা আবৃত করা মুসলিম তরুণীদের কন্সটেবল পরীক্ষার জন্য অ্যাডমিড কার্ড দিতে অস্বীকার করে। তাদের বক্তব্য, মাথায় কোনও কাপড় থাকা চলবে না। এর বিরুদ্ধে মুসলিম তরুণীরা আপত্তি করে। তাঁদের বক্তব্য, মাথা আবৃত করা তাঁদের ধর্মীয় অধিকার। এই নিয়ে বিক্ষোভ ছাড়াও কিছু মুসলিম সংগঠন কর্তৃপক্ষের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করে এবং সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়। পুলিশ রিত্রুটমেন্ট বোর্ডের কর্তৃপক্ষ বঞ্চিত তরুণীদের সঙ্গে এনিয়ে কোনও সংলাপ করতে রাজি হননি। কোনও সুরাহা না হওয়ায় কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন হাফিজা খাতুন, সোনামণি খাতুন সহ ৫জন পরিক্ষার্থী। কিন্তু সময়ের অভাবে ২৬ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পরীক্ষার আগে হাইকোর্টে শুনানি হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সোমবার, ২২ নভেম্বর বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের এজলাসে মামলাটির শুনানি হয়। আদালতে এই মামলার শুনানিতে মামলাকারী তরুণীদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং আইনজীবী ফিরদৌস শামিম প্রমুখ। ফিরদৌস শামিম বিচারপতিকে বলেন, মাথা ওড়না, স্কার্ফ বা শাড়ি দিয়ে আবৃত করলে কি নারীদের শারীরিক সক্ষমতা কিংবা বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়? ছবিতে আবেদনকারিনীদের মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ছিল। তাও কী কারণে এই সংখ্যালঘু তরুণীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করা হল? তিনি আরও বলেন, শিখ পুরুষরাও মাথায় পাগড়ি পড়ে পুলিশ ও সেনা বাহিনীতে রয়েছেন। তাঁদের মাথা আবৃত করায় পুলিশ রিত্রুটমেন্ট বোর্ডের কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু মুসলিম মেয়েদের ক্ষেত্রে। এটা অবশ্যই অন্যায় জুলুম। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম মাননীয় বিচারপতিকে বলেন, নিয়োগ হওয়ার পর পুলিশরাও ক্যাপ পড়ে মাথা আবৃত করে। সেদিকে অবশ্য পুলিশ রিত্রুটমেন্ট বোর্ডের কোনও আপত্তি নেই। এভাবে তুচ্ছ অজুহাতে সংখ্যালঘু তরুণীদের যাঁরা মূল ধারায় আসার জন্য প্রবল পরিশ্রম করছে, তাঁদের বঞ্চিত করা ইনসাফ ও সংবিধান বিরোধী। আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ও ফিরদৌস শামিম এ প্রসঙ্গে কেরল হাইকোর্টের একটি রায়ের উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, নিট পরীক্ষায় হিজাবধারী মুসলিম মেয়েদের সম্পর্কেও এই একই প্রশ্ন উঠেছিল। কেরল হাইকোর্ট স্পষ্ট ভাষায় বলে, ধর্মীয় স্বাধীনতায় কোনও ভাবেই হস্তক্ষেপ করা যাবে না। আইনজীবী বিকাশরঞ্জন বলেন, ধর্মীয় রীতি মেনে মুসলিম তরুণীরা ঘোমটার মতো করে মাথায় ওড়না টেনেছিলেন। তাতে তাঁদের মুখ কোনও ভাবেই ঢাকেনি। অথচ পুলিশ রিত্রুটমেন্ট বোর্ড তাঁদের আবেদনপত্র ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে অ্যাডমিট কার্ড দেয়নি। রাজ্য সরকার ও পুলিশের তরফে আইনজীবী চৈতালী ভট্টাচার্য বলেন, হিন্দু তরুণীদেরও পোশাক আগে ভিন্ন ধরণের ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। আর এই মামলার শুনানি হওয়া উচিৎ ট্রাইবুনালে, হাইকোর্টে নয়। তরুণীদের আইনজীবীরা বলেন, এই মামলায় সাংবিধানিক অধিকারের বিষয় রয়েছে। তাই হাইকোর্টেই এর বিচার হতে হবে। মাননীয় বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন করেন, শিখ ধর্মের মানুষ ধর্মীয় রীতি মেনে পাগড়ি পড়ার ছবি যদি ব্যবহার করতে পারে, তাহলে এখানে কেন আপত্তি তোলা হচ্ছে? তিনি আরও বলেন, বর্তমান মামলাটির রায়ের ওপরই নির্ভর করবে আগামীতে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ। তিনি আগামী বছরের ৬ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন। আইনজীবী চৈতালি ভট্টাচার্য বলেছেন, যেহেতু মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ, তাই পরবর্তী শুনানিতে সরকারপক্ষে এই মামলায় রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল অংশগ্রহণ করতে পারেন।