বাঙালি মানেই আড্ডায় থাকবে সিনেমা, নাটক, গান, কবিতা। এবছরটা বাংলা ছবির জন্য খুব ভালো একটা বছর। ইন্ডাস্ট্রি বেশ কয়েকটা ব্লকবাস্টার হিট, সুপারহিট, ছবি পেয়েছে। আজ ২০২৪-এর সেরা কয়েকটা বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা করলেন রামিজ আলি আহমেদ
বহুরূপী
পুজো রিলিজের ব্লকবাস্টার হিট এই ছবি।নন্দিতা-শিবপ্রসাদের এই ছবি এখনও হাউসফুল। লম্বা রেসের ঘোড়া, যা দৌড়চ্ছে আজও। ‘বহুরূপী’ এক ব্যাঙ্ক ডাকাতের গল্প।একদিকে ‘পুলিশ’ আবির, অন্যদিকে ‘ডাকাত’ শিবপ্রসাদের জবরদস্ত অভিনয় দেখার মতো। তুখড় অ্যাকশন সিকোয়েন্স।ছবির গান ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ এবং গানের লিরিক্স ‘বেশি তাকাস না বিয়ে দেবো কেন্দে মরে যাবি!’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।এই ছবিতে অভিনেত্রী কৌশানিকে নতুন রূপে পাওয়া গেছে।একেবারে অন্য ভাবনার ছবি ‘বহুরূপী’। ‘ব্ল্যাক স্টোরি’ সম্ভবত একেই বলে। অন্ধকারের গল্প, কিন্তু আলোয় মাখামাখি। শুধু আলোয় নয়, রঙেও। বহুরূপীদের সাজের রঙে। লোকশিল্পী বহুরূপী, মানুষ বহুরূপী, বিশ্বাস বহুরূপী। গাড়ি ধাওয়া করার টান টান দৃশ্য দিয়ে শুরু করে এই থ্রিলার কাহিনি পৌঁছে যায় সমাজের এক গভীর সত্যের ক্লাইম্যাক্সে।
খাদান
‘ফ্যামিলি নিয়ে ব্যস্ত আছি তো কী ভাবিছিস, অ্যাকশনটা ভুলে গেছি?’ ‘খাদান’-এর এই সংলাপেই অভিনেতা মনে করিয়ে দিলেন তিনি স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। কোলিয়ারি এলাকা, মাফিয়া রাজ, সিস্টেম-সিন্ডিকেটের মারপ্যাঁচ… থেকে নাচ-গান, রোমান্স, অ্যাকশনে ‘মশালা’ প্যাকেজে জমজমাট ‘খাদান’।
বলা ভালো এ যেন দেব’দর্শন। রাত দুটো থেকে ঠিকিট বিক্রি। সিনেমাহল হাউসফুল। এমন ক্রেজ বাঙালি হালফিলে বহুদিন দেখেননি। পর্যাপ্ত সিনেমা হল মারপ্যাঁচ পেরিয়ে ‘খাদান’এ ঢুকতে পেরেছেন দর্শক। মুখে দাড়ি,আলুথালু চুল এবং ক্লিন শেভড দুই লুকেই দেব দেখা দিয়েছেন। কয়লাখনিতে অ্যাকশন থ্রিলার জমে উঠেছে। দেব তাঁর গানেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, বছর শেষে সিনেমাহলে কে এসেছে, গানে-গানে, ‘যা যা বলে দে – তোর বাপ এসেছে!’আসলে দেব তো মাস ছবিরই হিরো।’টনিক’,’প্রজাপতি’, ‘প্রধান’ তাঁকে ক্রিটিকদের কাছে ভালো রিভিউ ও শহুরে দর্শকদের মন জয় করলেও প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ বা ইউং জেনারেশন কোথাও যেন দেবের সেই জনারটা মিস করেছিল।দেবের এই প্রত্যাবর্তন তাঁর ভক্তদের জন্য ও টলিউড ইন্ডাস্ট্রির জন্যও খুব দরকার ছিল।
‘সন্তান ‘
বাংলা ছবিতে ‘সন্তান’ নামে আগেও ছবি হয়েছে। কাহিনির ছক চিরচেনা হলেও পর্দায় টান টান উত্তেজনা। সৌজন্যে রাজ চক্রবর্তীর গল্প কথনের মুনশিয়ানা। আসলে ভাল রাঁধুনির হাতে সাধারণ পদের স্বাদও উপাদেয় ! ছবির শেষের দিকে অনুসূয়া মজুমদার যখন বলেন ‘মাই হাজব্যান্ড ইজ নট ফর সেল! (আমার স্বামী বিক্রি নেই)’, ভিড়ে ঠাসা মাল্টিপ্লেক্স ফেটে পড়ে হাততালিতে। না, শুধু হাততালিই নয়, উড়ে আসে এলোপাথাড়ি ‘সিটি’! বোঝা যায় আসলে ফ্যামিলি ড্রামারও রাজার রাজা রাজ!
‘সন্তান, সন্তান, সন্তান, সন্তান, সন্তান, সন্তান’…পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর ছবি প্রমোশনে বারবার এই শধের ব্যবহার নজিরবিহীন। ছবিতে তিন ‘চক্রবর্তী’। ঋত্বিক-মিঠুন এবং রাজ স্বয়ং! ফ্যামিলি ড্রামা ছবিতে ছাপ রেখেছেন রাজের রিয়েল স্ত্রী শুভশ্রী। ছবির বিষয়বস্তু পরিচিত আগেই বললাম। বয়স্ক বাবা-মায়ের শেষ আশ্রয় সন্তানের সান্নিধ্য নয়, বৃদ্ধাশ্রম। দক্ষিণী ফিল্মের দাপটে মধ্য এবং দক্ষিণ কলকাতায় শো পায়নি ‘সন্তান’!তাও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘সন্তান’।
এটা আমাদের গল্প
মানসী সিনহা -অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর নিজের পরিচয় যথেষ্ট। কিন্তু প্রথম ছবিতেই পরিচালক হিসেবে মানসী দেখালেন, বড়পর্দায় গল্প বলতে তিনি জানেন। এবং কোনও আঁতলামো নয়, এমনকী তথাকথিত কোনও ফর্মুলা অনুসরণ করাও নয়। অন্যরকম এক গল্প নিয়ে নতুন পথেই এগিয়েছেন মানসী এবং প্রথম ছবিতেই অনেকখানি শেষ পর্যন্ত শ্রীতমা ও প্রবীণের বিয়েটা কেমন হবে, তার জন্য দর্শকদের আগ্রহকে ধরে রেখেছে এই ছবি।
নির্ভেজাল প্রেম বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ে প্রৌঢ়া শ্রীতমা দেবী এবং প্রবীন শর্মা নামে এক প্রৌঢ়র জীবনে। তবে তাতেও ঝঞ্ঝাট আছে। সমাজ। দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। অভিনয়ে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ। এবং অপরাজিতা আঢ্য অতুলনীয়। বিষণ্ণ ব্যক্তিত্বের এক মায়া ছড়িয়ে পড়ে অপরাজিতার অভিনয়ে। পাশাপাশি খরাজ মুখোপাধ্যায়, সোহাগ সেন, কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবদূত ঘোষ উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেছেন। অনির্বাণ মাইতির সম্পাদনা গতি দিয়েছে ছবিকে।
অযোগ্য
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়-ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত জুটির ৫০তম ছবি ‘অযোগ্য’। এই বাংলা ছবিতে তাঁদের জুটি বড্ড চর্চিত।দীর্ঘ সময়ের এই জুটি অধিকাংশ ছবিতেই সুচিত্রা-উত্তমের মতো শেষ দৃশ্যে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ ঘরানার গল্পেই কাজ করেছেন। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নিজের ৩২তম ছবিতে জনপ্রিয় এই জুটিকে নিয়ে ব্যতিক্রমী কিছু করবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সাজানো ‘রোমান্টিক থ্রিলার’-এর বুনোট নিপুণতায় সাজানো।প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার পাশাপাশি শিলাজিৎ, লিলি চক্রবর্তী, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, সুদীপ মুখোপাধ্যায় প্রত্যেকের অভিনয় নজর কেড়েছে।
পদাতিক
মৃণাল সেনের বায়োপিক। পরিচালনায় সৃজিত মুখোপাধ্যায় । স্বাধীনতার দিন মুক্তি পায় ছবিটি। মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী। আর ‘মৃণাল’ চরিত্রটি যার হাতে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন তিনি মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুন্ডু।মৃনালপত্নী গীতা সেনের চরিত্রে ছিলেন মনামি ঘোষ।অল্পবয়সী মৃনাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করেন কোরক সামন্ত।এছাড়াও অভিনয় করেছেন বরুণ চন্দ, জিতু কামাল,ঐশানি দে, সুজন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
হুব্বা
আটের দশকে বাংলার অপরাধ জগতের কুখ্যাত গ্যাংস্টার হুব্বা শ্যামল-এর উত্থান। শোনা যায় এই দুর্বৃত্তের গুন্ডারাজ চলত গোটা হুগলি অঞ্চল জুড়ে। তোলাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ, খুন, পাচার-সহ একাধিক অপরাধমূলক ঘটনায় অভিযুক্ত সেই দুষ্টু লোকটার গল্প নিয়েই পরিচালক ব্রাত্য বসুর থ্রিলারধর্মী ছবি ‘হুব্বা’। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অভিনেতা মোশারেফ করিম। আইপিএস অফিসার সুপ্রতিম সরকারের ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ বইয়ের একটি পরিচ্ছেদ এই ছবির মূল অবলম্বন।
পারিয়া
পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায় নিজে পশুপ্রেমী। তাই পথকুকুরদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার বার্তা নিয়েই তিনি ‘পারিয়া’ ছবি নির্মাণ করেন। অ্যাকশন এবং থ্রিল মিশে ছবি জমজমাট। অবলা পশুদের গুরুত্ব দিয়ে বাংলায় প্রায় ছবিই হয়নি। তাদের ন্যূনতম অধিকারের জন্য লড়াইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। ছবির পরতে পরতে এই চেতনাকেই বারবার স্পষ্ট হয়েছে।২ ঘণ্টা ১৮ মিনিট-এর এই ছবিতে অভিনয় করেছেন
বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, অঙ্গনা রায়, সৌম্য মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, শ্রীলেখা মিত্র, লোকনাথ দে, দেবাশিস রায়, দেবপ্রসাদ হালদার প্রমুখ।
চালচিত্র এখন
অঞ্জন দত্ত পরিচালিত এবং সায়ন চক্রবর্তী অভিনীত এই ছবি কিংবদন্তি পরিচালক মৃণাল সেনের প্রতি একটি উৎসর্গ। এই ছবিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে মৃণাল সেন, নিজের কাজের মাধ্যমে ভারতীয় সিনেমাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের স্তরে। আরো বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিদীপ্ত চক্রবর্তী, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, সুপ্রভাত দাস ও অঞ্জন দত্ত ।
দাবাড়ু
পথিকৃৎ বসু পরিচালিত এই ছবি, গ্র্যান্ড মাস্টার সূর্য শেখর গাঙ্গুলির জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ছবিতে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী এবং অন্যান্যরা। এই ছবি দীর্ঘদিন ধরে দর্শকের পছন্দের তালিকায় ছিল।
বাবলী
রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় এবং আবির চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই ছবি বুদ্ধদেব গুহর গল্প অবলম্বনে তৈরি। ছবিটি প্রশংসার দাবি রাখে।
যমালয়ে জীবন্ত ভানু
এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে দেখা গিয়েছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এর ভূমিকায়। কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত একদম ভিন্ন ধরনের মজার ছবি, যা অনেকের ভাল লাগবে।
টেক্কা
সৃজিত-দেব জুটির এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল পুজোয়। টানটান থ্রিলার। সঙ্গে স্বস্তিকার ‘স্বাভাবিক’ অভিনয় এবং রূক্মিণীর একেবারে ‘ভিন্ন’ অভিনয় ভর করে বাংলা ছবির চলতি মুরশুমে ‘টেক্কা’। দেব-এর লুক চিত্রনাট্য টুইস্ট ছবিটি দর্শকদের প্রশংসা কুড়ায়।ছবিতে কবীর সুমনের গান রয়েছে। ছবির খল চরিত্রে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় চমকে দিয়েছেন। সাধারণ ভাবে মজার চরিত্রে কিংবা চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তাঁকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত।
মানিক বাবুর মেঘ
সাদামাটা সাদাকালো ছবি। চন্দন সেন আর আকাশে মেঘের অভিনয় দেখবার মতো। বারবার দেখবার মতো। দৃশ্যকল্প, ক্যামেরাশিল্প, আবহ, আলো কিংবা সম্পাদনা এ সবের ধার ধারেনি পরিচালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকৃতি প্রেম ও পরিণতি। শহুরে কংক্রিটের জঙ্গলে একটি মেঘলা প্রেমের গল্প। চন্দন সেন ছাড়াও ছবিতে রয়েছেন ব্রাত্য বসু-দেবেশ রায়চৌধুরীরা।
এছাড়াও মানসী সিনহার পরিচালনায় ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’ ছবিটি দর্শকদের ভালো লাগে।
এছাড়া আরো বেশ কিছু ছবি এবছর টলিউড উপহার দিয়েছে।