সিকিম থেকে ফিরে শুভ্রজ্যোতি ঘোষ-এর কলমে
পশ্চিম সিকিমের সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় একটি ছোট্ট জনপদ রিনচেংপং। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই পাহাড়ি জনপদ তখন ছিল অবিভক্ত বাংলাতেই। কারণ সিকিম তখনও ভাগ হয়নি। আর সেই রিনচেংপংয়ের বৌদ্ধ গুম্ফার প্রেমে পড়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তখন সদ্য শান্তিনিকেতন তৈরি করেছেন। আশ্রমিক জীবনের ফাঁকে সেই সময় কিছুদিনের জন্য চলে যান পাহাড়ে। বর্তমান পশ্চিম সিকিমের রিনচেংপংয়ে বসেই লিখে ফেলেন অনেক কিছুই। এখানকার ডাকবাংলোয় অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন কবিগুরু। আর এখানে বসেই লিখেছিলেন ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের সেই বিখ্যাত কবিতা। মাথার ওপর উত্তুঙ্গ হিমালয় তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। তাই বোধহয় ‘ঘুমন্ত বুদ্ধ’র কোলে এই ছোট্ট হ্যামলেটে বসে লিখে ফেলেছিলেন– ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য– উচ্চ যেথা শির।’ পরবর্তী কালে যে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। সেই ইংরেজি অনুবাদই ছিল গীতাঞ্জলির উপক্রমণিকা।
প্রকৃতিপ্রেমী বিশ্বকবির ‘মংপু’ কিংবা ‘শিলং’ যোগের কথা অনেকে জানলেও রিনচেংপং যোগের কথা অনেকেরই অজানা। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ যখন অত্যাচারে মগ্ন– তখন এই রিনচেংপংয়ের ডাকবাংলোতেই দিনের পর দিন কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এখান থেকেই নিজের লেখনির মাধ্যমে জাগ্রত করেছেন দেশাত্মবোধ। এমনকি পশ্চিম সিকিমের এই ছোট্ট জনপদের গুম্ফার (বৌদ্ধ মনাস্ট্রি) পাশে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অন্তিম সংস্কারের যে জায়গা রয়েছে সেখানে একটা সময় ছিল দুটি ছাতিম গাছ। সিকিমবাসী যাকে আদর করে ডাকে ছাতেম। আর সেই ছাতিমের তলাতেই বসে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। জায়গাটা বড্ড প্রিয় ছিল বিশ্বকবির। নীচ দিয়ে বয়ে গিয়েছে রঙ্গিত নদী। বিশ্ব প্রকৃতির এই যে রূপ দর্শণ করেছেন রবি ঠাকুর– তাতেই বোধহয় তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অপূর্ব সেই পংক্তি– ‘জ্ঞান যেথা মুক্ত– যেথা গৃহের প্রাচীর–আপন প্রাঙ্গনতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি।’
গুরুদেবের সেই ছাতিমতলা কালের নিয়মেই বিনষ্ট হয়েছে। ছাতিম গাছের শাখা প্রশাখা আজ আর বিস্তারিত নেই। তবে দুটি ছাতিম গাছের গুঁড়ি এখনও রয়ে গিয়েছে। আর সিকিমবাসীর মনের মণিকোঠায় রয়ে গিয়েছেন বিশ্বকবি। গুম্ফার পাশে তাঁর সেই বসার জায়গায় যাওয়ার রাস্তায় পড়বে একটি ফলক। যেখানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত এই জায়গার কথা উল্লেখ করা আছে। আর কবিগুরু যেখানে বসে আপন মনে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আপন সৃষ্টিতে মগ্ন থাকতেন– সেই জায়গাটাও সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছে সিকিম সরকার। বসার জায়গা থেকে শুরু করে ওপরে ছাউনি দিয়ে ঘেরা। বাতাস সেখানে রবির গান গেয়ে যায়। পাহাড়ি সুরে কোথাও যেন একাত্ম হয়ে যায় রিনচেংপং– গীতাঞ্জলি ও রবীন্দ্রনাথ।( ছবি প্রতিবেদক)