পুবের কলম প্রতিবেদকঃ হাজি মুহাম্মদ মহসিন নিজ অর্থে সমাজসেবার কাজ শুরু করেছিলেন ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ এবং সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের প্রায় সমসাময়িক কালে। তাঁর জন্ম ১৭৩৩ সালে হুগলিতে। বৃহস্পতিবার রাজ্যের সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের অধীন পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম-এর আয়োজনে ‘হাজি মুহাম্মদ মহসিন এনডাউমেন্ট ফান্ড স্কলারশিপ’ বিতরণ করা হল। একইসঙ্গে স্মরণ করা হল দানবীর এই মহান মানুষটি শিক্ষার প্রসারে যে কাজ করেছিলেন এবং যে বিপুল অর্থ তিনি শিক্ষা– সমাজসেবা ও ধর্মীয় কাজের জন্য রেখে গিয়েছিলেন তাঁর কথাও। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তাদের ভাষণে টুকরো টুকরো করে হাজি মুহাম্মদ মহসিনের জীবনবৃত্তান্ত ও অবদানের খণ্ডচিত্র উঠে আসে। বৃহস্পতিবার হাজি মুহাম্মদ মহসিন ফান্ড-এর স্কলারশিপ প্রদানের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন রাজ্য মন্ত্রিসভার ৭জন সদস্য।
এদের মধ্যে ছিলেন ফিরহাদ হাকিম– ব্রাত্য বসু– গোলাম রব্বানি– জাভেদ আহমদ খান– সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি– সাবিনা ইয়াসমিন– আখরুজ্জামান। এছাড়াও ছিলেন পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক ও প্রাক্তন সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান।
বিত্ত নিগমের অডিটোরিয়ামে মাধ্যমিক– হাইমাদ্রাসা ও আলিম-এর ৯৮জন কৃতী ছাত্র-ছাত্রীকে স্কলারশিপ প্রদান করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর হাজি মুহাম্মদ মহসিন ফান্ড স্কলারশিপ’ পুনরায় চালু করা হয়। এই স্কলারশিপ প্রদানের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কে যে অর্থ গচ্ছিত রাখা হয়েছিল তার আয় থেকে প্রতিবছর এই স্কলারশিপ এখন দেওয়া হচ্ছে। ২০১১-২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ২২জন কৃতী ছাত্র-ছাত্রীকে স্কলারশিপ প্রদান করা হয়েছে। এদিন স্কলারশিপ প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্টরা সমাজ কল্যাণে হাজি মুহাম্মদ মহসিনের অবদান ও আদর্শ উল্লেখ করেন।
হাজি মুহাম্মদ মহসিনের গুরুত্ব উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন– হাজি মুহাম্মদ মহসিন নিজে শিখেছেন– অপরকেও শিখিয়েছেন। পাশাপাশি শেখানোর জন্য সর্বদা অপরের পাশে থেকেছেন। তাই নিজে শিক্ষিত হওয়া এবং অপরকে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাজ্যের মু্খ্যমন্ত্রী চান সব শ্রেণির মানুষ শিক্ষায় এগিয়ে আসুক।
এ দিনের অনুষ্ঠানে পরিবহণ ও আবাসন মন্ত্রী ও কলকাতা পুরনিগমের মু্খ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম হাজি মুহাম্মদ মহসিনের আদর্শ অনুসরণ করার বার্তা দেন। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন– মু্খ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে মুসলিম তোয়াজের অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু– মু্খ্যমন্ত্রী মুসলিম তোয়াজ করেন না– তিনি মানুষ তোয়াজ করেন। এই সরকার শিক্ষা ও আর্থিক ক্ষেত্রে দুর্বল সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের চেষ্টা করছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতেও শ্মশানে যে পুরোহিতরা ধর্মীয় কৃত্যাদি পালন করেন তাঁদেরও বেতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা খানিকটা বঞ্চিত কারণ– তাদের শ্রাদ্ধ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে কেউ ডাকে না। তারা যাতে ১০-১২ হাজার টাকা মাসিক ভাতা পান কলকাতা পুরসভা তার ব্যবস্থা করেছে। আর মেয়র হিসেবে আমি সেই উদ্যোগকে রূপায়িত করেছি।
এদিনের অনুষ্ঠানে ‘পুবের কলম’ পত্রিকার সম্পাদক– রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ ও বিত্ত নিগমের অন্যতম বোর্ড সদস্য আহমদ হাসান ইমরান হাজি মুহাম্মদ মহসিনের জীবনাদর্শ তুলে ধরেন। তিনি বলেন– হাজি মুহাম্মদ মহসিন পলাশির যুদ্ধের আগে ১৭৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮১২ সালে ইন্তেকাল করেন। হাজি মুহাম্মদ মহসিন কতটা দানশীল ছিলেন– তা সকলে অবগত। মনে রাখতে হবে– হাজি মুহাম্মদ মহসিন ও তাঁর মতো মনীষীদের অবদানকে আমাদের মনে রাখতে হবে। ‘হাজি মুহাম্মদ মহসিন ফান্ড’ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সংখালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম এই স্কলারশিপ চালু করেছে। এতে প্রায় একশো জন ছাত্র-ছাত্রী এই স্কলারশিপ পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন।
আহমদ হাসান ইমরান এ প্রসঙ্গে বলেন– বিত্ত নিগম প্রতি বছর প্রায় ৪০ লক্ষ স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। আর এ ক্ষেত্রে বিত্ত নিগম ভারতের মধ্যে সেরা। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আহমদ হাসান ইমরান বলেন– তাঁর দান শুধু পশ্চিমবঙ্গে সীমিত ছিল না। বাংলাদেশের রাজশাহী– চট্টগ্রাম– ঢাকা-সহ প্রভৃতি শহরে তাঁর দান প্রসারিত হয়েছিল। চট্টগ্রামে তাঁর নামে বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের দানে তাঁর নামে হুগলিতে কলেজ ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে উর্দু– ইংরেজি– বাংলাতে পড়াশোনা করানোর ব্যবস্থা ছিল। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাংলার বহু বিখ্যাত মানুষ বের হয়েছেন। ফুরফুরার পীর সাহেব দাদাহুজুর হুগলি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। বাংলাদেশের দুজন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং আজিজুর রহমান এই হুগলি মাদ্রাসার ছাত্র। বিজ্ঞানী কুদরুতে খোদাও এই মাদ্রাসার ছাত্র।
রাজ্য সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী মুহাম্মদ গোলাম রব্বানি বলেন– মু্খ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে রাজ্য সংখ্যালঘু দফতরের দ্বারা মানুষরা উপকৃত হচ্ছেন। দেশের মধ্যে রাজ্যের সংখ্যালঘু দফতর অন্যতম স্থান দখল করেছে। বিহারের সংখ্যালঘু দফতরের বাজেট যেখানে ৪০০ কোটি টাকা– সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংখ্যালঘু দফতরের বাজেট ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকারও বেশি।
জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি বলেন– বিত্ত নিগমের এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে। বর্তমান রাজ্য সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৬ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপ দিয়ে দেশের মধ্যে নজির সৃষ্টি করেছে।
বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খানের বক্তব্য– মানুষ পড়তে চায়। তাদের সুযোগ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। শিক্ষার উন্নতিতে রাজ্য দেশের মধ্যে অন্যতম স্থানে রয়েছে।
রাজ্য সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন– হাজি মুহাম্মদ মহসিনের চিন্তাভাবনা ছিল বড়। সমাজের দরিদ্র– পিছিয়ে পড়াদের জন্য নিজের সম্পত্তি ও জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আখরুজ্জামান বলেন– ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাজ্য সরকার সাইকেল বিতরণ– স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে সুনাম অর্জন করেছে। এদিনের অনুষ্ঠানে ছিলেন রাজ্যের সংখ্যালঘু দফতর এবং বিত্ত নিগমের আধিকারিকরা।