ইনামুল হক, বসিরহাট: ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’- এ আলো যে মাটির প্রদীপের তা কেবল এই শ্যামা সংগীতের স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম যে জানতেন তা নয়, সময়কালের উপযোগী ও মাঙ্গলিক অর্থে এই মৃত্তিকা প্রদীপ যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মের মানুষের আরাধ্য দেব-দেবীর পায়ের নীচে আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলছে।
বাংলার সংস্কৃতিতে এ প্রদীপ যেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে উত্তরণের পথ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে ডিজিটাল টুনি বাল্বও যেন তার সময় অতিবাহিত করে ফেলেছে। আলো নিয়ে কারসাজি, আলোর ঝরনা, আলোর ঝকমকি এর মধ্যেও মাটির প্রদীপের চাহিদা সব পূজাতেই প্রায় অপরিহার্য। আর বাঙালির শারদ উৎসবের পর বৃহৎ আয়োজন শ্যামাপুজো উপলক্ষে আলোর উৎসব দীপাবলি।
গৃহস্থের অন্দরে, বাহিরে, ঠাকুরদালানে, অলিতে গলিতে ছোট ছোট জোনাকির মতো বৈদ্যুতিন টুনি বাল্বের পাশাপাশি আজও সমান চাহিদা রয়েছে কুমোর পাড়ার হাতে গড়া মাটির প্রদীপের। যেখানে ৩-৪ বছর আগেও নানা রংবেরঙের আলোর ঝলকানিতে হারিয়ে যেতে বসেছিল মাটির প্রদীপের শিখা।
কিন্তু ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেও এখনো মানুষ আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় ফেলে আসা চিরন্তন গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। তাছাড়া প্রথা ও বাঙালির বিশ্বাস অনুযায়ী প্রদীপের আগুন শিখা যে মাঙ্গলিক এবং পূজোয় অপরিহার্য। তাই মৃৎশিল্পের কারিগর তথা কুমোরেরা হতাশার মধ্যেও স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি।
তাই দুর্গাপুজোর পরেই এই প্রদীপ তৈরির কারিগরদের পড়ে যায় ব্যস্ততা।কারণ দীপাবলিতেই মাটির প্রদীপের অর্ডার আসে বিভিন্ন জায়গা থেকে। দুর্যোগের ঘনঘটার মধ্যেই বাঙালির বড় উৎসবের পাঠ মিটে যেতেই কাদামাটি নিয়ে কুমোরের ‘চাকে’র ধারে বসে যান এইসব গ্রামীণ মৃৎ শিল্পীরা।
কুমোর পাড়ার উঠোনে রোদের আশায় হাজার হাজার কাঁচা মাটির প্রদীপ শুকানোর অপেক্ষায় থাকে। সাহেব খালির বাসিন্দা ভোলানাথ হালদার জানালেন, ‘ডানা’র হাওয়া লাগতে না লাগতেই কাঁচা প্রদীপগুলো যেন নষ্ট হতে বসেছিল। তাই নিম্নচাপের বৃষ্টির পর মাঝেমাঝে রোদের উঁকি মারতেই তড়িঘড়ি শুকিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় সুন্দরবন, বসিরহাট, বারাসাত সহ বিভিন্ন এলাকার কুমোর পাড়াগুলিতে। প্রায় আধ শুকনো অবস্থায় এলামাটির প্রলেপ লাগিয়ে পুড়িয়ে পাঁজা থেকে বের করে আনা হয় বাজারজাত করার জন্য।
উত্তর ২৪ পরগনার সুন্দরবনের সাহেব খালি পালপাড়ার দেখা গেল মাটির প্রদীপ তৈরিতে ব্যস্ততা। কাঠালবেরিয়া পাল পাড়ার পূজারানী পাল জানালেন, গত বছরের তুলনায় এবছর বিক্রি বাটা অনেক ভালো আছে।পাইকারি খুচরা অর্ডার ও আসছে।কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা ঠিকমত প্রদীপ রেডি করে উঠতে পারছেন না বা শুকাতেও পারছেন না। তাতে অসুবিধা হচ্ছে।
Read more: ঘৃণ্য চক্রান্ত! ৮ কোটি টাকার লোভে প্রেমিকের সঙ্গে মিলে স্বামীকে খুন, উদ্ধার পোড়া দেহ
প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে উপেক্ষা করে যেটুকু যা তৈরি করতে পারছেন তাই যোগান দেওয়া হচ্ছে। তবে মাটির প্রদীপের চাহিদা দেখে মনে হচ্ছে ইলেকট্রিক লাইটের ঝলকানির মধ্যেই মাঙ্গলিক অর্থে নতুন করেই মাটির প্রদীপে ফিরে আসছে গ্রাম বাংলা থেকে শহরতলি।