Sun, September 29, 2024

ই-পেপার দেখুন
logo

পবিত্র আশুরার তাৎপর্য


ইমামা খাতুন   প্রকাশিত:  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৫:৪৬ এএম

পবিত্র আশুরার তাৎপর্য

আগামী ১৭ জুলাই অর্থাৎ ১০ মুহাররম পবিত্র আশুরা। এ নিয়ে লিখছেন  ফারহানা আনজুম

 

ইসলাম হচ্ছে এক পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ। ইসলামের যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হয় আরবি মাসের তারিখ  অনুযায়ী। আরবি বছরের প্রথম মাস মুহাররম মুহাররম অর্থ  সম্মানিত। আমাদের ধর্মীয় জীবনে নানা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কারণে মাসটি অত্যন্ত সম্মানিত। তাই এই মাসটির নামকরণ হয়েছে মুহাররম । এই মাসের ১০ তারিখ ইসলামের  ইতিহাসে অত্যন্ত স্মরণীয়, তাৎপর্যময় এবং মর্যাদাপূর্ণ। এই তারিখটি তাই  ‘আশুরা’ নামে বিশেষ মহিমায়  মুসলমানদের কাছে সম্মানিত হয়ে আছে।

পবিত্র আশুরা প্রতি বছর ফিরে ফিরে এসে আমাদের মনে করিয়ে দেয় অতীতের অনেক বিষাদময় স্মৃতি। যা থেকে আমরা সামনে চলার নতুন শপথ নিয়ে সত্যকে আঁকড়ে ধরে চলার প্রেরণা পাই। আমাদের প্রিয় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর দৌহিত্র হযরত হোসাইন রা. কারবালার ফোরাত নদীর তীরে ৬১ হিজরীর ১০ মুহাররম শহীদ হন।   এর পূর্বেও আছে পবিত্র আশুরার দিনে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য  ঘটনা। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম আ.-কে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ১০ মুহাররম সৃষ্টি করেন। আবার  তিনি আরাম-আয়েশের বেহেশত হতে পৃথিবীতে আসেন মুহাররমের এই ১০ তারিখে।  

এ ছাড়াও আছে আরও নানান ঘটনা। যেমন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ১০ মুহাররম পবিত্র আশুরার দিনে আমাদের এই  সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেন। এই দিনে তিনি নীল আকাশ  থেকে মেঘমালা সৃষ্টি করে প্রথম পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষণ করান।      

পৃথিবীর জন্ম থেকে আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত  এক লক্ষ কিংবা মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী, পয়গম্বর, রাসূল আল্লাহ্তায়ালা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তার মধ্যে অনেক নবীর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই মুহাররম মাসের ১০ তারিখ   আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে। হযরত নূহ আ. ছিলেন একজন নবী, তিনি  প্রায় সাড়ে নয়শো বছর ধরে তাঁর কওমের মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচার করে ব্যর্থ হন। ওইসব  পাপী লোকেরা হযরত নূহ আ.-এর কথায় মোটেই কর্ণপাত করেনি। তারা এমনভাবে পাপের পথে পা বাড়ালো যে নূহ  আ. তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে বদ-দোয়া করলেন। আর  তারই ফলস্বরূপ আল্লাহ্পাক হযরত নূহ আ.-কে একটি বড় কাঠের নৌকা তৈরির নির্দেশ দিলেন। কাঠের নৌকা তৈরি শেষ হল, তাতে আল্লাহ্ পাকের আদেশ অনুযায়ী ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ এবং প্রতিটি প্রাণী এক জোড়া করে তোলা হল। তারপর শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। মুষলধারে একটানা চল্লিশ দিন। শুরু হল প্লাবন। পানির তোড়ে ভেসে গেল  মাঠ-ঘাট-জনপদ। মারা পড়ল এক এক করে পাপী গুনাহগার মানুষেরা। মারা পড়ল অনেক জীব-জন্তু। শুধু নূহ আ.-এর নৌকায় যারা ছিল তারাই বেঁচে রইল। নৌকা পানির উপর ভাসতে ভাসতে ১০ মুহাররম আশুরার দিনে জুদি পাহাড়ে  এসে লাগে এবং প্লাবনের হাত থেকে তিনি পরিত্রাণ পান।

এ ছাড়াও পবিত্র আশুরার দিনে নবী হযরত মূসা আ. এবং তাঁর অনুসারীরা যালিম বাদশাহ্ ফেরাউনের অত্যাচার- নির্যাতন থেকে মুক্তি পান। এই দিনে নবী হযরত ইউনুস আ.-এর কওমের তাওবা আল্লাহ্তায়ালা কবুল করেন। এই তারিখে নবী হযরত ইব্রাহীম আ. এবং হযরত ঈসা আ.  জন্মগ্রহণ করেন।

১০ মুহাররম পবিত্র আশুরার দিনে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন  বিশাল আকাশ, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, লাওহ-কলম  ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেন। এই দিনে হযরত ইব্রাহীম আ. ‘খলিল’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং এই দিনেই তিনি আবার  নমরূদের আগুনের কুণ্ড থেকে আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছায় মুক্তি পান।

নবী হযরত মূসা আ. তুর পাহাড়ে আল্লাহ্ পাকের সঙ্গে কথা  বলেছিলেন এই পবিত্র আশুরার তারিখেই। চল্লিশ বছর পর  এই দিনে হযরত ইউসুফ আ. ও হযরত ইয়াকুব আ.-এর মধ্যে পরস্পর বিছিন্ন থাকার পর পুনরায় দেখা হয়। মাছের  পেটে ক্রমাগত চল্লিশ দিন থাকার পর হযরত ইউনুস আ. এই দিনে মুক্তি লাভ করেন। ইয়াহুদিদের অত্যাচার ও বর্বরতা থেকে হযরত ঈসা আ. মুক্তি লাভ করে আসমানে গমন করেন। এই একই দিনে হযরত দাউদ আ.-এর দোয়া আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন কবুল করেন। এই দিনে পবিত্র কাবার প্রথম ‘গিলাফ’ লাগান হয়। এই পবিত্র দিনে আমাদের প্রিয় নবী সা. মা হযরত খাদিজা রা.-কে বিবাহ  করেন, এই ১০ মুহাররম পবিত্র আশুরার দিনে আবার কিয়ামত সংঘটিত  হবে।

প্রথমেই উল্লেখ করেছি, ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে  হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনায় হযরত ইমাম হোসাইন রা. নির্মমভাবে শত্রুদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। কারণ ছিল রাসূল আকরাম হযরত মুহাম্মদ সা.-এর কন্যা মা ফাতেমা রা. ও ইসলামের চতুর্থ 'লিফা হযরত আলি রা.-এর পুত্র হযরত হোসাইন রা. ছিলেন প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের  দাবিদার। হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর মৃত্যু হলে খেলাফত-শূন্য  হয়ে পড়ে। তদস্থলে মুয়াবিয়া রা.-এর পুত্র ইয়াজিদ নিজেকে খেলাফতের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে  শাসনভার নিজ হাতে তুলে নেন। ইয়াজিদ তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য হযরত হোসাইন রা.-কে নির্দেশ পাঠান, কিন্তু হযরত হোসাইন রা. ইয়াজিদের এই অন্যায় নির্দেশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেকে খেলাফতের প্রকৃত হকদার হিসেবে ঘোষণ করেন। তাঁর   পিতা হযরত আলি রা.-এর খেলাফতকালে তাঁর রাজধানী ছিল কুফা নগরীতে। তাই এখানে হযরত হোসাইন রা.-এর প্রতি অনুগত লোকের সংখ্যা ছিল বেশি। হযরত হোসাইন রা. মদিনা থেকে কুফা যাওয়ার জন্য মনস্থ করলেন। তাছাড়া তিনি কুফাবাসীর নিকট হতে একটি চিঠিও পেয়েছিলেন, যাতে তাঁকে সেখানে গেলে সর্বপ্রকার  সাহায্য-সহযোগিতার কথা উল্লেখ ছিল।

তিনি মদিনা থেকে কুফার উদ্দেশে ইরাকের পথে রওনা হলেন। এর পূর্বেই হযরত হোসাইন রা. তাঁর চাচা মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তিনি শুনলেন যে, তাঁর চাচা মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদ প্রকাশ্যে হত্যা করেছে। এই হত্যার প্রতিবাদ পর্যন্ত কেউ করেনি বা দুঃখ প্রকাশ পর্যন্তও করেনি। এ খবর শুনে  হযরত  হোসাইন রা. মর্মাহত হলেন। তবু তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পে অটল থাকলেন। তিনি সামনের পথ ধরে এগিয়ে চললেন নিজের সঙ্গীসাথী ও পরিবার-পরিজনসহ। কিন্তু তিনি ফররুদ হতে কাদাসিয়ার পথ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াজিদের এক হাজার সৈন্য এসে তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়াল। এই সৈন্যদলের নেতৃত্বে ছিল হোর ইবনে ইয়াজিদ। হযরত হোসাইন রা.-কে হোর ইবনে ইয়াজিদের ওপর নির্দেশ ছিল তাঁকে কুফার শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের নিকট হাজির করা। হযরত হোসাইন রা. হোরের কথা শুনে বিস্মিত হলেন, তিনি বললেন, ‘তিনি স্বেচ্ছায় এখানে আসেননি। কুফাবাসীর আমন্ত্রণপত্র পেয়েই তো কুফার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু ওরা তা অস্বীকার করল। মূলত এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা।

অতঃপর হযরত হোসাইন রা. মদিনায় ফেরত আসতে চাইলেন। কিন্তু হোর ইবনে ইয়াজিদের সৈন্যরা তাঁরও গতিরোধ করে দাঁড়ালেন। তাঁকে পুনরায় কুফায় তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলা হল। কিন্তু তিনি রাজী  হলেন না। এ পর্যায়ে ইবনে যিয়াদ তাকে এমন পথে যাত্রা শুরু করতে বললেন যে-পথ  মদিনার দিকে নয়, আবার কুফার দিকেও নয় এমন পথে যাত্রা শুরু করুন। বাধ্য হয়ে হযরত হোসাইন রা. তাঁর সঙ্গীসাথী পরিবার-পরিজনসহ অন্য এক পথে রওনা হলেন। হোর ইবনে ইয়াজিদ তাঁকে অনুসরণ করে। এবং পেছন থেকে বার বার তাঁকে সন্ধি করার প্রস্তাব দিয়ে আনুগত্য প্রকাশের কথা বলতে লাগলেন, কিন্তু এতে মোটেই কর্ণপাত করলেন না হযরত হোসাইন রা.।

হযরত হোসাইন রা.  আবার পথ চলা শুরু করলেন।  ইতিমধ্যে কুফা থেকে একজন দূত এসে হোরের হাতে একটি চিঠি দিল। ওই চিঠিতে লেখা ছিল হযরত হোসাইন  রা. যেন ফিরে যেতে না পারেন, তিনি যেন কোথাও টিকতে না পারেন এবং কোনও লোকালয়ে আশ্রয় বা তাঁবু ফেলতে না পারেন। চিঠির কথা হোর হযরত হোসাইন রা.-কে জানিয়ে দিলেন। বাধ্য হয়ে আর এগুনো সম্ভব হল না। হযরত হোসাইন রা.-সহ সঙ্গীগণ কারবালার প্রান্তরে তাঁবু ফেললেন, দিনটি ছিল ২ মুর্হারম, ৬১ হিজরী।

হযরত হোসাইন রা. এখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। শত্রু- সৈন্যরা তাঁর চারিদিক ঘিরে ফেলল। তাঁবুতে পানি পর্যন্ত বন্ধ করে দিল। অনাহারে পিপাসায় ফুলের মতো শিশুরা প্রাণ দিতে লাগল। বার বার আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তাব উড়িয়ে দিলেন হযরত হোসাইন রা.। শুরু হল যুদ্ধ। শত্রু-সৈন্য হাজার হাজার। অপরদিকে আল্লাহর ঈমানী শক্তিতে  বলীয়ান মাত্র বত্রিশজন ঘোড়সওয়ার। অল্পক্ষণের মধ্যে ঘোড়াগুলো তীরের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে অকেজো হয়ে গেল, বাধ্য হয়ে ঘোড়সওয়াররা পদাতিক সৈন্যরূপে যুদ্ধ করতে লাগল। হযরত হোসাইন রা.-এর অনেক সঙ্গী শাহাদাত বরণ করল, অবশেষে হযরত হোসাইন রা. একা যুদ্ধ করতে লাগলেন। অতঃপর দীর্ঘক্ষণ লড়াইয়ের পর তিনি শত্রুর হাতে শাহাদাত বরণ করেন (ইন্নাল্লিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহি রাজ্বিউন)।  

‘আশুরা’ এলে আমরা তাই শোকে মুহ্যমান হয়ে যাই। ‘হায় হোসেন! হায় হোসেন!’ মাত্ম তুলি। বুক চাপড়াই। কিন্তু এটা আশুরার প্রকৃত শিক্ষা নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, পাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে  সত্য  প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উৎসর্গ করাটাই হল পবিত্র আশুরার অন্তনির্হিত তাৎপর্য।