Sun, September 29, 2024

ই-পেপার দেখুন
logo

হিন্দুত্বের ট্রেনিং সেন্টারে পরিণত হচ্ছে নালন্দা: অমর্ত্য


Bipasha Chakraborty   প্রকাশিত:  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১০:৪৮ এএম

হিন্দুত্বের ট্রেনিং সেন্টারে পরিণত হচ্ছে নালন্দা: অমর্ত্য

 

বিশেষ প্রতিবেদন:  কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তমনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বদলে হিন্দুত্বের ট্রেনিং সেন্টারে পরিণত করতে চলেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। বুধবার বোলপুরে একটি পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, নালন্দায় আমি আচার্য থাকাকালীন ইংল্যান্ড, আমেরিকা থেকে যাঁরা পড়াতে এসেছিলেন, আমি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও বিদায় নিয়েছেন। সেটাকে মেরামত করতে গিয়ে সরকার নালন্দাকে বোধহয় এখন ট্রেনিং গ্রাউন্ডে পরিণত করছে। সেটা সিভিল সার্ভিসের ট্রেনিং হতে পারে, আবার ভবিষ্যতের হিন্দুরাষ্ট্রের ট্রেনিংও হতে পারে।

ইউপিএ সরকারের সময়কালে নতুন করে স্থাপিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিযুক্ত করা হয়েছিল অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর তিনি সরে যান। তারপরে নালন্দাকে ঘিরে সরকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাবে অনেকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অমর্ত্য সেন। এ দিন তিনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ভারতের নানা বিড়ম্বনা, পিছিয়ে থাকার কারণ শিক্ষার অভাব। তাই শিক্ষার মান নিয়ে সত্যিই চিন্তার কারণ আছে। কিন্তু সেটা যে খুব মানা হচ্ছে তা নয়।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় খুব বড় প্রতিষ্ঠান, সেখানে চতুর্থ শতাধী থেকে চিন, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশ থেকে পড়াশোনা করতে আসত। তাদের পড়াশোনার মান খুবই উন্নত ছিল। আচার্য হিসেবে আমিও সেখানে অনেককে শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম। পরে আমি আচার্য হিসেবে থাকলে সরকার সাহায্য করবে না বুঝে বেরিয়ে আসি। আচার্য পদে সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী এলেন। কিন্তু স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হলেও তাঁকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। বৌদ্ধ নেতৃত্বে যা তৈরি হয়েছিল, সেটাকে সংকীর্ণ অর্থে হিন্দুরাষ্ট্রের ভূমিকা বলে তৈরি করা হল।

অমর্ত্য সেন আরও বলেন, শুনেছি বিহারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে এখন নালন্দার স্থান ২২টির মধ্যে ১৮তম। এটাকে তো আর সন্তোষজনক বলা যায় না। কিন্তু তাতে নাকি মাথাব্যথা নেই সরকারের। এ কথাও শুনলাম, এই নাকি নালন্দা স্থাপিত হল এবং সেটা হল সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শিক্ষার মান বুঝতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কতটা হচ্ছে তা নিশ্চয়ই দেখতে হবে। হিউয়েন সাং জানালা দিয়ে দেখতে পেতেন নালন্দার মাথাটা মেঘে ঢাকা কি না। তা থেকে দিনটা কেমন যাবে বুঝতে পারতেন। তিনি এক বছর ধরে হেঁটে এসেছিলেন। তাঁকে এখানেই থেকে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন, আমি যদি কিছু শিখে থাকি, আমার অন্যত্র তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। যেখানে শিখেছি, সেখানে থেকে যাওয়াটা ঠিক নয়।

ডুংরি প্রকাশনীর ‘অমর্ত্য সেন সংখ্যা’ প্রকাশ উপলক্ষ্যে বোলপুরে আয়োজিত এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে শিক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মনোভাবের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের এক অন্যকে সহ্য করা বড় কথা নয়। একসঙ্গে কাজ করাটাই বড় কথা। ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকৃত অর্থে দূরত্ব কমানো অনেকে মানতে চান না। তাজমহলের মতো ভালো কিছু তৈরিতেও নানা অংশের সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলী প্রতিফলিত। বিদেশি ভাষায় প্রথম উপনিষদের অনুবাদ করেন দারা শিকো; সংস্কৃত থেকে ফারসিতে। সেটা থেকেই ম্যাক্সমুলার ইংরেজি, জার্মানিতে অনুবাদ করেন। কাজেই সব অংশ থেকেই অনেক কিছু নেওয়ার দরকার আছে; রবীন্দ্রনাথেরও সেটাই ইচ্ছা ছিল। এই নিয়ে তাঁর বহু লেখা আছে।  হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ভারত কোনও সাম্প্রদায়িকতার হাতে পড়ুক এটা রবীন্দ্রনাথ চাননি, আমরাও নিশ্চয়ই চাইব না।’

ভারতে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ফারাক নেই, এ কথা বোঝাতে রসিকতাপূর্ণ গল্পও বলেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, ‘আমার দাদামশাই ক্ষিতিমোহন সেনের বড় দাদা অবনীমোহন সেন তাঁর এক বন্ধু মুসলিম মাওলানার বাড়ি যেতেন। তিনিও আসতেন এবং একই সঙ্গে হুঁকো বা গড়গড়া খেতেন। একদিন নতুন তামাক পেয়ে দু’জনে উপভোগ করার সময় এক হিন্দু  চক্রবর্তী সেখানে ছিলেন। মাওলানা তাঁকেও যোগ দিতে  আহ্বান জানালেন। চক্রবর্তী বললেন, আপনাদের সঙ্গে মেশা আমার চলে না, আমাদের মধ্যে মিল নেই। তাঁর উত্তরে মাওলানা তাঁকে বলেন, আমাদের মধ্যে বড় মিল আছে। আপনি  অজ্ঞ হিন্দুদের  মাথায় হাত বুলিয়ে রোজগার করেন, আমি অজ্ঞ মুসলিমদের। আমরা একই কাজ করি।’