Fri, September 20, 2024

ই-পেপার দেখুন
logo

কুসংস্কারের বলি দুই আদিবাসী, পুলিশি তৎপরতায় ধৃত মূল অভিযুক্ত সহ পনেরোজন


Bipasha Chakraborty   প্রকাশিত:  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৫:১০ পিএম

কুসংস্কারের বলি  দুই আদিবাসী, পুলিশি তৎপরতায় ধৃত মূল অভিযুক্ত সহ পনেরোজন

দেবশ্রী মজুমদার,  ময়ুরেশ্বর: স্রেফ কুসংস্কারের বলি দুই আদিবাসী মহিলা।  কুসংস্কারতার জেরে দুই আদিবাসী মহিলাকে পিটিয়ে খুনের ঘটনা বীরভূমের ময়ুরেশ্বরে। সমাজমাধ‍্যমে নজরদারির মাধ‍্যমে এই ঘটনা নজরে আসে পুলিশের। তারপর অতি তৎপরতার সাথে মূল অভিযুক্ত সহ পনেরোজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একুশজনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়। 


ডাইনি অপবাদ দিয়ে সংগঠিত ভাবে দুই আদিবাসী মহিলাকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে এই খুন বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় গ্রামের মোড়ল ও তার ছেলে সহ পনেরোজনকে  গ্রেফতার করেছে ময়ুরেশ্বর থানার পুলিশ। মোট একুশ জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে দুই মৃতার মেয়েদের অভিযোগের ভিত্তিতে। 


ঘটনার এরপর একুশজনের নামে অভিযোগ দায়ের করে গ্রামের মোড়ল লক্ষ্ণীকান্ত সরেন সহ পনেরোজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিস। তাদের এদিন আদালতে তোলা হয়েছিল। 


মৃত লোদগি কিস্কুর মেয়ে রাণী কিস্কুর কথায়, ‘‘গ্রামের দেবাংশী লক্ষ্ণীকান্ত সরেন এটা করিয়েছে। ও গাঁয়ের দেবাংশী। আমাদের কিছু না বলে মাকে এমনভাবে টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলল। শাসানির ভয়ে ঘটনা প্রকাশ‍্যে আছে ঘটনার পাঁচদিন পর। 

উল্লেখ্য, ময়ুরেশ্বরের কেসেডাঙ্গাল পাড়া ও হরিসড়া পাড়া পাশাপাশি দুই পাড়া। কেসেডাঙাল পাড়ার বাসিন্দা লোদগি হাঁসদা (৬০) ও হরিসড়া পাড়ার ডলি সরেন (৪০) তাদের বাপের হরিসড়া গ্রামে মনসা পুজো উপলক্ষ্যে এসেছিলেন। তাদের দুজজনকে নিয়ে দিনকয়েক ধরেই ‘ঝাড়ফুঁক’, ‘মন্ত্র দেওয়া’ এইসব হিড়িক তোলা হয়েছিল গ্রামের মোড়ল ও তার অনুগামীদের তরফ থেকে।


এই দুই মহিলার জন্য গ্রামের ছেলেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে এই অপবাদ তুলে গত রবিবার মনসা পুজোর দিন রাত্রে দুই মহিলাকে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে যায় গ্রামের একাংশ পুরুষ ও মহিলা। এরপরই চলে বেধড়ক মারধর। সেই মারধরের ভিডিও সেই সময় করে ফেলেন কোনও এক বাসিন্দা। সেই ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর রীতিমত স্তম্ভিত হতে হয়েছে। প্রায় বিবস্ত্র দুই মহিলার উপর চলছে চড়-থাপ্পর। লাঠির বাড়ি। মাটিতে আছড়ে ফেলে এলোপাথাড়ি লাথির চোটে রীতিমত কাতরাচ্ছেন দুই মহিলা। হাতজোড় করে প্রার্থনা করছেন এই অমানবিক অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়ার।


কিন্তু সেই কাতর আর্তিতে কর্ণপাত করার নুন‍্যতম ইচ্ছা উপস্থিত কারোর মধ্যে দেখা যায় নি সেই ভিডিওতে। বরং এমনও দেখা গেছে, কেউ কেউ ধুম্রপান করতে করতে রীতিমত ‘উগভোগ’ করছেন সেই অত্যাচারের দৃশ্য। এরপরের ঘটনা আরও করুন। গ্রাম ও পুলিসের সূত্রেই জানা গেছে, এমন অত্যাচারের দুই দিনমজুর মহিলা নিথর হয়ে গেলে তাদের বেঁধে গ্রাম লাগোয়া কাঁদরে  ভাসিয়ে দেওয়া হয়ে এবং সাথে সাথে গ্রামের মাতব্বরদের তরফে গ্রামবাসীদের শাসানো হয় মুখ না খোলার জন্য। এদিকে দিনের পর দিন দুই মহিলার নিঁখোজের ঘটনায় কারো হেলদোল না থাকুক, তাদের পরিবারের লোকজনদের উদ্বেগ আতঙ্ক ছড়ায়।


গোটা ঘটনার নেপথ্যে  কুসংস্কার। ডাইন অপবাদের হিড়িক তুলে এই পাশবিক ঘটনার ভিডিও তোলেন এক গ্রামবাসি। সমাজমাধ‍্যমে ভাইরাল হতেই পুলিশের নজরে আসে গোটা বিষয়টি।  দলবেঁধে বেধড়ক মারের চোটে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়া দুই মহিলাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রাম লাগোয়া কাঁদরের জলে। সেই দুই দেহ উদ্ধার হয়েছে পাঁচ দিন পরে।


 শনিবার  ভোরে এলাকার সেচ নালা থেকে দু’জনের দেহ উদ্ধার করা হয়। গোটা ঘটনাটি জানাজানি হতে সেখানে পৌঁছায় ময়ূরেশ্বর থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী। গ্রাম সংলগ্ন সেচ নালা থেকে দুই মহিলার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ময়নাতদন্তের জন্য দেহ দু’টি রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই ঘটনার পর গ্রামে আতঙ্ক রয়েছে। টহল দিচ্ছে পুলিশ। জেলা পুলিশ তরফে জানানো হয়েছে, ঘটনার তদন্ত চলছে। 

মৃতের পরিবারের অভিযোগ, ঘটনার কথা পুলিশকে না জানানো এবং অভিযোগ না দায়ের করার জন্য চাপ দেওয়া হয় তাদের।


গ্রামের অনেকে তাদের এসে ভয় দেখিয়ে যান বলেও অভিযোগ। মৃত মহিলার কন্যা জবা কিস্কু বলেন, ‘‘আমার মাকে যাঁরা নিয়ে গিয়েছেন, যাঁরা মেরেছেন, আমি তাঁদের শাস্তি চাই। আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। বলছে, ‘থানায় যাস না। না হলে পরে বুঝবি।’ আমাদের বিষয়টি চেপে যেতে বলা হচ্ছে। কী করে চেপে যাব? হাজার হলেও সেতো আমার মা। ওদের সঙ্গে এমন হলে চেপে যেত? আমরা দুই বোন, দুই ভাই। আমরা ওদের শাস্তি চাই।’’


মৃতের অপর কন্যা রানি কিস্কু বলেন, ‘‘আমাদের মাকে যাঁরা এ ভাবে কষ্ট দিয়ে মারল, আমরা তাদের ফাঁসি চাই। বাড়ি থেকে মাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আমার ভাইরা বাড়িতে ছিল না। এখন ওরা যাতে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে, সেই নিরাপত্তা চাইছি।’’


এই ঘটনায় ধৃত লক্ষ্মীরামের স্ত্রী সুরমিলা মাড্ডি বলেন, ‘‘আমার স্বামী ঘুমোচ্ছিলেন। তিনি কিছু জানতেন না। ওরা তুকতাক করত। আমার ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিল। বলছিল, ‘তোর ছেলেকে খাব, তোর স্বামীকে খাব।’ আমার ছেলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আমরা গিয়ে দুই চড় মেরেছি। গ্রামের সবাই মিলে মেরেছে। এর বেশি জানি না। ’’