Bipasha Chakraborty প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৬:৪০ এএম
বিপাশা চক্রবর্তী: সালটা এখন ২০২৪। সময় জেট গতিতে দৌড়াচ্ছে। ঘড়ির কাঁটার থেকেও যেন আগে চলেছে সময়। সেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলতে পারলেই যেন তাকে পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়ার একটা প্রবণতা বাড়ছে। পিছনের সারির তকমা 'তুমি খুব খুব বোকা’। সাদাসিধে শিশু মন কখনও এই তাচ্ছিল্য বুঝতে পারছে না, আবার কখনও সেই অপমান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
শিল্পীর মননশীল মন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেই মন কখন বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে সমস্ত দুয়ার ভেঙে দেওয়ার ডাক দেয় চুপিসারে, আবার কখনও কষ্ট বুকে সযত্নে লালন করে সৃষ্টিতে মগ্ন হয়ে ওঠে।
বর্তমান সময়ে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের যুগে শৌর্য সরকার সেই ব্যতিক্রমী কিশোর। বছর ষোলোর মন পুরস্কার, কৃতিত্ব, সৃষ্টি বোঝে না। তবে নিজের মতো করে সৃষ্টির নেশায় সে মত্ত। হাতের কাছে যা পায় সেই দিয়ে সে গড়ে তোলে মূর্তি। ইতিমধ্যে তার তৈরি করা বুদ্ধমূর্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে দুর্গামূর্তি নজর কেড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। ঝুলিতে এসেছে অনেক পুরস্কার। কালীঘাটের বাসিন্দা শৌর্য ম্যাট্রিক্স মর্ডান স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র।
শৌর্যর কথায়, আমার কল্পনা দিয়েই আমি মূর্তিগুলি গড়ে তুলি। তিন চার বছর বয়স থেকেই রং, মাটি নিয়ে খেললেও, যখন আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম তখন থেকেই মূর্তি তৈরি করতে ভালো লাগত। তখন জানতাম না, কিভাবে এই মূর্তিগুলি তৈরি হয়। তাই আটা-ময়দার মণ্ড দিয়েই নানা রকম মূর্তি গড়তাম। কিন্তু সেগুলো বেশিদিন থাকত না, কারণ ওগুলো পিঁপড়ে খেয়ে নিত। আটার মধ্যে তুঁতে দিয়ে করলে নষ্ট হত না। এখন বড় হয়েছি। তাই মূর্তি তৈরির কায়দা শিখেছি। অনেক এক্সিবিশন করেছি। আমার স্কুলের শিক্ষিকারা আমাকে খুব অনুপ্রেরণা দেন এবং নানাভাবে সাহায্য করেন। আর বাবা-মা আমার বন্ধুর মতো, সব সময় পাশে থাকে।
শৌর্যর বাবা সৌমিক সরকার পেশায় সরকারি কর্মচারী। মা তনুশ্রী সরকার পেশায় এক বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা।
সৌমিকবাবু ও তনুশ্রীদেবীর কথায়, শৌর্য আগে যে স্কুলে পড়ত সেখানে ওর বন্ধুরা ওকে নানাভাবে উক্ত্যক্ত করত, মারধরও করেছে। স্কুলে অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। প্রিন্সিপ্যালের কাছে শুনতে হয়েছিল, ‘শৌর্য স্বাভাবিক কিশোর নয়, ওকে ওই ধরনের স্কুলে দিন’। সেইসময়ের দিনগুলি আমাদের কাছে খুব কষ্টের ছিল। শৌর্য অনেক লড়াই করেছে।
তনুশ্রীদেবী বলেন, একজন শিক্ষিকা হয়ে বলব একটি শিশুমনের আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু সেটাই দিনের পর দিন হয়েছে আমার সন্তানের সঙ্গে। প্রথমে শৌর্য কিছু বলত না, আমরাও বুঝতে পারিনি। পরে সব জানতে পারি। এখন দেখি সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ও (শৌর্য) নিজের কষ্টগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। ভাবি একটা এত ছোট ছেলে এত সুন্দর কাজ করে কিভাবে। কিন্তু ওকে দেখি নিজের মনে কাজ করে চলেছে। একাগ্রতা দেখলেও অবাক লাগে। অনেক সময় মূর্তি তৈরি করতে সকাল ১০টায় বসে বিকেল ৪ টে পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ করেছে চলেছে।
এই প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় মত্ত থাকে, কিন্তু শৌর্যকে দেখি, ওই সব নিয়ে ওর কোনও আকর্ষণ নেই। নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত।
সৌমিকবাবু জানান, "শৌর্য আগে যে স্কুলে পড়ত, সেখানে সরল সাদাসিধে হওয়ার দরুণ তাকে অনেক সময় হাসির পাত্র হতে হয়েছিল। বন্ধুরা মারধর করত। কষ্ট হলেও নিজের মধ্যে গুমড়ে থাকত, কাউকে বুঝতে দিত না। পরে আমরা জানতে পেরে ওকে ম্যাট্রিক্স মর্ডান স্কুলে দিই। "
তনুশ্রীদেবীর কথায়, "শৌর্য গতবছর অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে। একটি স্কুলে ছোট থেকে পড়ে, ফের এই সময় অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জের ছিল ওর কাছে। শৌর্য নিজে নিজের মতো করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখনো চেষ্টা করছে। সৃষ্টিতে ওর আনন্দ। দেখে আমাদের ভালো লাগে। আগে ছেলের এই অবস্থায় এক একটা দিন আমরা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি। "
শৌর্য'র ভেতরের শিল্পীসত্ত্বাকে যিনি যথাযথ ভাবে চিনতে পেরে তাকে টেনে বের করে এনেছেন, তিনি হলেন শুভংকর বাসু (রানাদা)। উনিও পেশায় ও ভালোবাসায় একজন শিল্পী। ওঁনার স্নেহে, তত্ত্বাবধানে, উৎসাহে শৌর্য অনেক কিছু শিখেছে। সর্বোপরি ও (শৌর্য) এই শিল্প কে ভালোবাসতে শিখেছে। ওর কল্পনাপ্রবণ, সৃজনশীল মনকে ওড়ার জন্য ডানা মেলতে শিখিয়েছেন রানাদাই। তবে ভাস্কর এর পাশাপাশি ও নানারকম বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারে, যেমন তবলা, কিবোর্ড, মেলোডিকা ইত্যাদি। সংগীতের এর প্রতি ছোটবেলা থেকেই ওর একটা ভালোবাসা ছিল এবং আছে। একজন মা হিসেবে চাই আমার ছেলে একজন সুন্দর মনের মানুষ হয়ে জীবনে বড় হয়ে উঠুক। অভিভাবক হিসেবে এর থেকে বেশি আর কিছু চাই না। শৌর্য জানিয়েছে, সে বড় হয়ে ভাস্কর হতে চায়।