Sun, September 29, 2024

ই-পেপার দেখুন
logo

নিহত আবু সিদ্দিকের বাড়িতে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশন


Bipasha Chakraborty   প্রকাশিত:  ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৫:৪৮ এএম

নিহত আবু সিদ্দিকের বাড়িতে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশন
নিহত আবু সিদ্দিকের বাবার সঙ্গে কথা বলছেন কমিশনের সদস্যরা।

নির্মম অত্যাচারের বিবরণ রেকর্ড করলেন প্রতিনিধি দল

 

পুবের কলম প্রতিবেদক: আবু সিদ্দিক হালদার। এই নামটি এখন খবরের কাগজ, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এমনকি গুগল সার্চ করলেও দেখা যায় সারা ভারত এবং বিদেশেও ঢোলাহাটের একটি অখ্যাত গ্রামের পুলিশি বর্বরতার ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছে। ঢোলাহাট থানার পুলিশ সম্পূর্ণ নির্দোষ এক তরুণকে নৃশংস ও অমানবিক নির্যাতনের দ্বারা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ। 

বর্তমানে নিহত ওই তরুণের বিষয়টিতে সিআইডি তদন্ত হবে বলে সরকার ঘোষণা করেছে। কিন্তু এখনও সেই তদন্ত শুরু হয়নি। 

একটি সংখ্যালঘু তরুণকে যেভাবে পুলিশ নির্যাতন করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য বেশ কয়েকটি সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ মাইনোরিটি কমিশনকে স্মারকলিপি প্রদান করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান-এর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল শুক্রবার ঢোলাহাটের কাছে ঘাটবকুলতলা গ্রামে নিহত তরুণের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার বাবা, দুই চাচা এবং মা-সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন।

কমিশনের প্রতিনিধি দলে ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান মাইকেল শেন কালর্ভাট, মেম্বার সতনাম সিং আলুয়ালিয়া, ম্যাডাম শেহনাজ কাদরি, অশোক তুরাখিয়া, কমিশনের আধিকারিক সুবোধ চৌধুরি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ডিস্ট্রিট মাইনোরিটি অফিসার অমর বিশ্বাস প্রমুখ। 

কমিশনের সদস্যরা সরাসরি পুলিশি নির্যাতনে নিহত তরুণ আবু সিদ্দিক হালদারের বাড়িতে উপস্থিত হন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবু সিদ্দিকের পরিবারটি গ্রামের সজ্জন পরিবার বলে পরিচিত। নিজ চেষ্টায় আবু সিদ্দিকের তিন চাচা ব্যবসা করে একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছিল। চাচা আনসার আলি হালদার এবং আবু সিদ্দিক কর্নাটকের গুলবর্গা অঞ্চলে সোনার অলঙ্কারের কারিগর হিসেবে কাজ করত। তাঁদের সেখানে নিজস্ব ছোট কারখানাও ছিল। আবু সিদ্দিক মাত্র কয়েকমাস আগে বিয়ে করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী। 

নিহত আবু সিদ্দিকের বাড়িতে যাওয়ার পর দেখা যায় পুরুষ সদস্যরা সকলেই জুম্মার নামায আদায় করে তখনও ফেরেননি। তাঁদের সঙ্গে কমিশনের সদস্যরা কথা বলতে গেলে, তাঁদের একটাই আবেদন ছিল, কেন ঢোলাহাট থানার পুলিশরা মিথ্যা অভিযোগে আমাদের সমগ্র পরিবারের একমাত্র ছেলেকে বলতে গেলে আমাদের চোখের সামনেই এত নির্মম ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করল? তাঁরা জানান, ঢোলাহাট থানার এসআই রাজদীপ সরকার এবং অন্য তিন-চারজন পুলিশ আবু সিদ্দিককে থানার মধ্যে নিয়ে কখনও দোতলায় বা কখনও ছাদে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে পেটাতে থাকে। তাঁর গুহ্যদ্বারে পুলিশের লাঠি প্রবেশ করিয়ে আঘাত করতে থাকে এবং যৌনাঙ্গে বিদ্যুতের শক প্রয়োগ করে। পেটে, বুকে চড়ে বুট-সহ তিনজন পুলিশ নির্যাতন করতে থাকে। 

আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, একই বাড়ির বাসিন্দা আবু সিদ্দিকের যে চাচা মহসীন হালদারের সোনা চুরি গিয়েছিল বলে মহসীন সাহেব বাড়ি ও প্রতিবেশীদের বলেছিলেন, সিভিক পুলিশের মাধ্যমে খবর পেয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এসআই রাজদীপ সরকার তরুণ আবু সিদ্দিকের বাড়িতে হাজির হয়। সিভিক পুলিশের মাধ্যমে রাজদীপ সরকার জানতে পেরেছিল যে, মহসীনের ঘরে স্বর্ণের ব্যবসার জন্য কিছু সোনা মজুত ছিল। তার মূল্যমান ১৫ লক্ষ টাকার বেশি হবে। যা স্থানীয় দু’জন ছেলে চুরি করেছে বলে স্বীকারও করেছিল। অনেকে বলছেন, রাজদীপ সরকারের চোখ ছিল এই স্বর্ণের উপর। এই এসআই আবু সিদ্দিককে এবং যার ঘর থেকে চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ সেই মহসীন হালদারকে একসঙ্গে আটক করে গভীর রাতে ঢোলা থানায় নিয়ে যায়। আর সেখান থেকে শুরু হয় আবু সিদ্দিকের উপর অকথ্য নির্যাতনের পালা। আবু সিদ্দিককে মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার জন্য কোমরে দড়ি বেঁধে গভীর রাতে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

পরিবারের লোকেরা জানান, রাজদীপ প্রস্তাব দেয়, ২ লক্ষ টাকা দিলে আবু সিদ্দিকের উপর নির্যাতনের বহর কমানো হবে। ফের আবু সিদ্দিককে থানায় নিয়ে এলে পরদিন আইসি মানস চ্যাটার্জির সামনে ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চলতে থাকে পাশবিক অত্যাচার। এরপর ৩ জুলাই, ২০২৪ রাতে এসআই ও ‘তদন্তকারী অফিসার’ রাজদীপ সরকারের হাতে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা পরিবারের লোকেরা তুলে দেয়। আবু সিদ্দিকের উপর নির্যাতনের এক পর্যায় রাজদীপ ও আরও দু-একজন পুলিশ কর্মী তার দাড়ি উপড়াতে থাকে। এই সময় এসআই রাজদীপ এবং অন্য পুলিশ কর্মীরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে থাকে। আবু সিদ্দিক যখন অত্যাচারের চোটে আল্লাহ-র নাম নিচ্ছিল তখন রাজদীপ ব্যঙ্গ করে বলে, ‘তোর আল্লাহ কী তোকে বাঁচাতে পারল?’ 

এই ধরনের নির্মম অত্যাচারের কথা শোনেন ও তার ভিডিয়ো করেন কমিশনের সঙ্গে আগত সাংবাদিক-ফটোগ্রাফার। এইসব বর্ণনা শুনে কমিশনের সদস্যরা বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তাঁরা আবু সিদ্দিকের অসুস্থ মাকে সান্ত্বনা দেন। 

কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান বলেন, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি রাজ্য নয়। এখানে এখনও ন্যায়ের শাসন চলে এবং সুবিচার পাওয়া যায়। এই ঘটনার অবশ্যই সঠিক তদন্ত হবে। আর দোষীরা যাতে আইন অনুযায়ী শাস্তি পায়, তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা হবে।